ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্রে মানুষকে উৎসাহিত করা হোক

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সঞ্চয়পত্রে মানুষকে উৎসাহিত করা হোক

একটি দৈনিকে ‘সঞ্চয়পত্রের’ ওপর একটি সংবাদ পড়লাম। সংবাদে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। এতে সরকারের সুদ খরচও যথেষ্ট বেড়েছে। সংবাদে একটা উদ্বেগের সুর। এতে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের ‘নিট বিক্রি’ (ক্রয় ও নগদায়নের পার্থক্য) হয়েছে ১৫,৭০০ কোটি টাকার। এটা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের খবর। পূর্ববর্তী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ‘নিট বিক্রির’ পরিমাণ ছিল মাত্র ৪,৯৮৩ কোটি টাকা। খবরে বলা হয়েছে, ‘সঞ্চয়পত্র’ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেয়ার কথা ছিল ৯,০৫৬ কোটি। সেই তুলনায় ‘নিট বিক্রির’ পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। এখানে উল্লেখ্য, দুদিন পরপরই খবরের কাগজে সঞ্চয়পত্রের ওপর এ ধরনের সংবাদ ছাপা হয়। সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলেও ছাপা হয়, কম বিক্রি হলেও ছাপা হয়। উভয়ক্ষেত্রেই প্রায় সংবাদেই একটা আতঙ্ক, আশঙ্কার ‘আন্ডারটোন’ থাকে। সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে প্রায় সংবাদেই যেসব কথা বলা হয় তার একটা সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি। বলা হয়, আমানতের ওপর সুদের হার কম বিধায় সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে আমানতের অভাব দেখা দিচ্ছে। সরকারকে প্রচুর সুদ দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কিনছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব প্রচার ও অপপ্রচারের কথা শুনে সরকারের কেউ কেউ তখন লেগে যায় সঞ্চয়পত্র ক্রয় নিরুৎসাহিত করতে। সুদের হার কমানো, সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের উর্ধসীমা কাটছাঁট করা, সঞ্চয়পত্রের সংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি হয়ে ওঠে সরকারের কার্যক্রম ও পদক্ষেপ। এখন আবার একই কথা বোঝা যাচ্ছে। আমি সঞ্চয়পত্রের ওপর লেখালেখি করি এ কথা যারা জানে তারা অনেকেই আমাকে ফোন করেছেন। তারা ভীষণ আতঙ্কে আছেন। তাদের একমাত্র আয়ের পথ এটি। এর ওপর সরকার আবার খড়হস্ত হলে তাদের সর্বনাশ হবে এই হচ্ছে তাদের কথা। একথা সত্য সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমলে সাধারণ সঞ্চয়কারীরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি এদিকটিতে এখন যাচ্ছি না। আমি অন্য কয়েকটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। বলা হয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকগুলোর আমানত কমে। এই মুহূর্তের খবর হলো ব্যাংকগুলোর আমানতের কোন প্রয়োজন নেই। তাদের হাতে প্রচুর টাকা অলসভাবে পড়ে আছে। তারা সেসব টাকা ব্যবহার করতে পারছে না। বিনিয়োগের পরিস্থিতি আশানুরূপ নয়। এই মুহূর্তের ঘটনার কথা বাদ দিই। আমি শক্তভাবে বিশ্বাস করি সঞ্চয়পত্র ও মেয়াদী ব্যাংক আমানত তুলনীয় পণ্য নয়। সঞ্চয়পত্র দীর্ঘমেয়াদী, এর তারল্য খুবই সীমিত। অসময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গালে ‘দ-ি’ দিতে হয়, সুদ হারাতে হয়। যখন তখন সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানো যায় না। যেখানে সেখানে সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। সঞ্চয়পত্র ‘লিয়েন’ রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া যায় না। সঞ্চয়পত্র অফুরন্ত কেনা যায় না। একেক ধরনের লোকের জন্য একেক ধরনের সঞ্চয়পত্র। মহিলাদের জন্য এক রকম, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের জন্য এক রকম, ওয়েজ আর্নারদের জন্য এক রকম এবং সাধারণের জন্য এক রকম। বলা বাহুল্য, এই নিরিখে ব্যাংকের মেয়াদী আমানত সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। এসব যখন তখন ভাঙ্গানো যায়। এদের তারল্য খুব বেশি। অসময়ে ভাঙ্গালে সঞ্চয়ী হিসাবের সুদ পাওয়া যায়। যেখানে যেখানে যত ইচ্ছা তত আমানত করা যায়। হাজার হাজার ব্যাংক শাখা। আমানত রাখার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের শ্রেণীবিন্যন্সত করা হয় না। অতএব ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্র তুল্য কোন পণ্য নয়। তুল্য না হলে এদের মধ্যে তুলনা করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। দ্বিতীয় কথা আমানত হ্রাস-বৃদ্ধির। কেউ কেউ বলেন, সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। এ কথাটি কতটুকু সত্য। আমরা জানি সঞ্চয়পত্র হচ্ছে সরকারের ঋণ। সরকার অনেকভাবে ঋণ নেয়। ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে জরুরী ভিত্তিতে বিপদে পড়ে ঋণ নিতে পারে। আবার জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারে। জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার সাধারণ মাধ্যম হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে টাকা পায় তা সরকার কোথায় রাখে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকে? নিশ্চয় নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের হিসাব আছে। ওখান থেকে টাকাটা তুলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে যায়। মন্ত্রণালয়গুলো সেই টাকা আবার ব্যাংকেই রাখে। তাই নয় কী? এতে যা হয় বেসরকারী আমানতের টাকাটা সরকারী আমানতে পরিণত হয় সাময়িকভাবে। আবার সরকার যখন উন্নয়নের জন্য টাকা খরচ করতে থাকে তখন সেই টাকা আবার বাজারে যায় এবং তা পায় নানা ধরনের লোক- শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী, নির্মাণকর্মী, কনট্রাক্টর ইত্যাদি শ্রেণীর লোক। অতএব একথা ঠিক নয় যে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়লে ব্যাংকগুলোর আমানতে টান পড়ে। অথচ দেখা যায় সাধারণভাবে এতে ব্যাংকারদের মধ্যে কেউ কেউ সঞ্চয়পত্র বিক্রিকে দোষারোপ করতে থাকে। এবার অবশ্য তা নেই। এবার কাগজে দেখলাম একজন ব্যাংকার নাকি বলেছেন, বর্তমানে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। জানি না কোন্ ধরনের ব্যবসায়ীদের কথা তিনি বলেছেন। প্রথমেই বলে রাখা দরকার, ব্যবসায়ীরা সঞ্চয়পত্রে কেন, ব্যাংকেই টাকা রাখতে চায় না। কারণ ব্যবসাতে লাভ-মুনাফা-রিটার্ন অনেক অনেক বেশি। এরপরও কারও যদি বিনিয়োগযোগ্য টাকা বেশি থাকে তাহলে তা রাখবে ব্যাংকেই। ব্যাংকে টাকা রাখার কোন সীমা নেই। নিয়ম-নীতির মধ্যে যে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে। যদি তার অলস টাকা থাকে। বর্তমানে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। এই টাকা কী সঞ্চয়পত্রে যাচ্ছে? যেতে পারে খুবই সামান্য টাকা। কারণ সঞ্চয়পত্র অফুরন্ত কেনা যার না। পাঁচবছরী সঞ্চয়পত্র, তিনবছরী সঞ্চয়পত্র থেকে শুরু করে সব সঞ্চয়পত্রের ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া আছে। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র পঞ্চাশ লাখের বেশি ক্রয় করা যায় না। এটা শুধু মহিলাদের জন্য। পাঁচ বছরী সঞ্চয়পত্র পঁয়ত্রিশ লাখ টাকার বেশি ক্রয় করা যায় না। সরকারী অবসরপ্রাপ্তদের সঞ্চয়পত্রেরও উর্ধসীমা আছে। অতএব, ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে রাখছে একথা ঠিক নয়। অধিকন্তু এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, গ্র্যাচুয়িটির টাকাও সঞ্চয়পত্রে রাখা যায় না। এমতাবস্থায় একথা বলা ঠিক নয় যে, দেশে বিনিয়োগের মন্দাভাব দেখে ব্যবসায়ীরা তাদের কোটি কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে রাখছে। এবার আসা যাক সরকারের সুদ-ব্যয় সম্পর্কে। পত্রিকার খবর পড়ে অনেক সময় মনে হয় সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ দিতে দিতে সরকার ‘ফতুর’ হয়ে পড়ছে। এ কথাটি কতটুকু সত্য? প্রকৃতপক্ষে সরকার প্রতিবছর কত টাকা সুদব্যয় করে সঞ্চয়পত্রের ওপর? ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন আমার সামনে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম এ তথ্য। দেখা যাচ্ছে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকার পাঁচবছরী সঞ্চয়পত্রে সুদব্যয় করেছে ১,০৬২ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি সুদ-ব্যয় (২৪৫৮ কোটি টাকা) হয়েছে ‘পরিবার সঞ্চয়পত্রে’। এটি একটি খুবই জনপ্রিয় সঞ্চয়মাধ্যম। অবশ্যই শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এটা করা হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। দেশের যেকোন নারী পঞ্চাশ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ক্রয় করতে পারে। এতে সুদের হার একটু বেশি- প্রতিমাসে সুদ বা লাভ তোলা যায়। এদিকে দেখা যায় তিন মাস অন্তর অন্তর সুদবাহী সঞ্চয়পত্রের ওপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদব্যয় হয়েছে মাত্র ১,৩৫১ কোটি টাকা। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদ-ব্যয় হয়েছে মাত্র ৮৭৩ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে সঞ্চয়পত্রে সুদ্য-বয়ের পরিমাণ মাত্র ৭,৭৯৫ কোটি টাকা। এখানে আছে ১৫ ধরনের নানাজাতের সঞ্চয়পত্র ও বন্ড ইত্যাদির হিসাব। এখন যদি প্রশ্ন করা যায় এই খরচ কি খুব বেশি। আবার কথা আছে। এই সুদের ওপর নাকি আয়কর আছে। এটা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না। অথচ অনেকের কাছ থেকেই এসব সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর কর কেটে নেয়া হচ্ছে। অতএব, প্রকৃত মোট সুদ-ব্যয় (সুদ আয়কর) হবে আরও কম। এদিকে সরকার প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের আওতায় সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা পড়ে না। এরা সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। এতে আছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মহিলা, বিধবা মহিলা, মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ইত্যাদি শ্রেণীর লোক। তারা বিপদের দিনে কারও কাছে হাত পাততে পারে না। এখানে আছে লাখ লাখ লোক। তাদের জন্য সরকার কি বছরে সুদ-ব্যয় হিসেবে কিছু টাকা রাখতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে সরকার বাজার থেকে ঋণ করে। ব্যাংক থেকে করে, অন্যান্য সূত্র থেকেও করে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া যায় যে সরকারের সুদ-ব্যয় সঞ্চয়পত্রে প্রায় দ্বিগুণ (বাজারের তুলনায়) তাহলেও বছরে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় এই মুহূর্তে হবে দুই-তিন হাজার কোটি টাকা। লাখ লাখ অসহায় মানুষের জন্য এই বার্ষিক ভর্তুকিটি কি মাত্রাতিরিক্ত? মোটেই নয়। আশা করি সরকার এসব কথা মনে রেখে সঞ্চয়পত্রের ওপর সিদ্ধান্ত নেবে। সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের ইস্যুটি লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, এ্যাকাউন্টিং নয়। এতে জড়িত লাখো-কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। লেখক : প্রাক্তন প্রফেসর, বিআইবিএম
×