ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খোদ জেলা কমান্ডারের পদ চলে গেছে অমুক্তিযোদ্ধার হাতে

পটুয়াখালীতে ভুয়াদের দাপট ॥ কোণঠাসা মুক্তিযোদ্ধারা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পটুয়াখালীতে ভুয়াদের দাপট ॥ কোণঠাসা মুক্তিযোদ্ধারা

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা/নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী, ২৬ ফেব্রুয়ারি ॥ পটুয়াখালীতে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়াছড়ি। যে কেউ যখন তখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করে বসছেন। কেউ কেউ কাগজপত্র বানিয়ে নিয়েছেন। নিচ্ছেন সরকারী-বেসরকারী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এরই মধ্যে জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক হাজার তিন শ’য়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে আরও কয়েক শ’ নাম মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়াছড়ির কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খোদ জেলা কমান্ডারের পদ চলে গেছে অমুক্তিযোদ্ধার হাতে। এমনকি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সুপারিশের বদৌলতে ডাকসাইটে রাজাকার-আলবদররা ঢুকে পড়েছেন সরকারী বিভিন্ন দফতরের উচ্চ পদে। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য কোটাও রাজাকার-আলবদরদের সন্তানরা দখল করে নিচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এতসব অনিয়ম-অব্যবস্থার চিত্র পাওয়া গেলেও তা দেখার কেউ নেই। পটুয়াখালী জেলায় লাল মুক্তিবার্তায় ৪শ’ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে কারও কারও নাম নিয়ে সে সময়েই প্রশ্ন উঠেছিল। আবার কারও কারও নাম বাদ পড়ারও অভিযোগ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারী সুযোগ-সুবিধা যত বেড়েছে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তত বেড়েছে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এরপরেও জেলায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনক্রমে ৫ থেকে ৭শ’র বেশি হতে পারে না বলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন। জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সরদার আবদুর রশিদ, যুদ্ধকালীন কমান্ডার আলতাফ হায়দার, কাজী আলমগীরসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জানান, একাত্তরে পটুয়াখালী ছিল দুর্গম এলাকা। এখান থেকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সে সময়ে প্রায় দুঃসাধ্য কাজ ছিল। তারপরেও জীবনবাজী রেখে অনেকেই গেছেন। জেলার অভ্যন্তরে একাধিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারপরেও সব মিলিয়ে কোনক্রমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫-৭ শ’র বেশি হতে পারে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অভিমত উড়িয়ে দিয়ে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার তিনশ’। আরও কয়েকশ’ মানুষের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অপেক্ষমাণ রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে বাউফল উপজেলায়। সেখানে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পাঁচশ’ ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে অপেক্ষমাণদের তালিকাও দীর্ঘ। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাউফলকে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কারখানা’ নাম দিয়েছেন। আর এজন্য একজন প্রভাবশালী রাজনীতিককে দায়ী করা হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, ওই রাজনীতিক প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক সরকারী গেজেট বের করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে চলছেন। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়েই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খোদ জেলা কমান্ডারের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন আবদুল হালিম। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ জেলা কমান্ডার আবদুল হালিম আদৌ মুক্তিযোদ্ধা নন। বাউফলের কারখানা দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ তৈরি করে নিয়েছেন। যদিও আবদুল হালিম এ অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছেন। সরকারী কোন তালিকা কিংবা কোন গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহ-কমান্ডার (অর্থ) ইউসুফ নাসিমের নাম নেই। অথচ সম্মানী ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব ধরনের সরকারী সুযোগ-সুবিধা তিনি বছরের পর বছর ভোগ করে আসছেন। এ বিষয়ে জেলা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার নির্মল কুমার রক্ষিত জানান, যাছাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে ইউসুফ নাসিমের নাম সরকারী কোন গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া যায়নি। আর সে কারণে ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক সভায় ইউসুফ নাসিমকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যদিও ইউসুফ নাসিম এ অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। পটুয়াখালী জেলার সবগুলো উপজেলাতেই এমন ধরনের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার রীতিমতো ছড়াছড়ি পড়েছে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকে পড়ছে রাজাকার-আলবদররা। তারা বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারী চাকরিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত মোক্তার হোসেন মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোঠায় চাকরি নিয়েছেন। অথচ তার বাবা দশমিনা উপজেলার রনগোপালদী গ্রামের বাসিন্দা মনসুর আলী জমাদ্দার ছিলেন এলাকার অন্যতম স্বাধীনতাবিরোধী। মনসুর আলীর নাতি তোফাজ্জেল হোসেনও একইভাবে পোষ্য কোঠায় পুলিশের উপপরিদর্শকের (এসআই) চাকরি নিয়েছেন। দশমিনা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মনসুর আলী নাম না থাকলেও কি করে তার ছেলে এবং নাতি মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোঠায় পুলিশের চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন, তা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দশমিনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নাজির আহমেদ জানান, মনসুর আলী জমাদ্দার নামে কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম তার জানা নেই। সে কোথায়, কবে কার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তাও জানা নেই। আসলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখন অসহায়। এমনকি বর্তমান উপজেলা কমান্ডেও এসব অমুক্তিযোদ্ধাদের পদ-পদবী রয়েছে। ২০১০ সালে এখানে যাচাই-বাছাই হওয়ার কথা থাকলে তা আজ পর্যন্ত হয়নি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গলাচিপা-দশমিনা আসনের এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন জানান, মুনসুর আলীর গোটা পরিবার বিএনপি করে এবং স্বাধীনতাবিরোধী। ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি নেয়ায় গত বিএনপি আমলেই মোক্তার হোসেনের চাকরি চলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তার চাকরি পুনর্বহাল হয়। এ বিষয়ে মতামত জানার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোক্তার হোসেনের ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে প্রতিবারই তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পটুয়াখালীর আরেক শীর্ষ রাজাকার গলাচিপা উপজেলার আমখোলা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল গফুরের ছোট ভাই আবদুর রব, ১৯৭১ সালে যিনি ছিলেন নিহায়েত ১৩-১৪ বছরের কিশোর। যার গোটা পরিবার ছিল স্বাধীনতাবিরোধী। অথচ সেই আবদুর রব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের বলে ১৯৮৭ সালে বিসিএস কোটায় চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি বিচার বিভাগে ভোলায় কর্মরত রয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনি স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় জেলও খেটেছেন। এ বিষয়ে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাউফল থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের পরিবারের কয়েক সদস্য একই কায়দায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারী চাকরি নিয়েছেন।
×