ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ------------------ প্রায় শেষ হতে চলেছে অমর একুশের মাস। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারিজুড়ে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় ছিল নানা উৎসব অনুষ্ঠান। বলা বাহুল্য, সবচেয়ে বৃহৎ উৎসবটির নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মাসের প্রথম দিন থেকে চলছে। বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিনই বসছে লেখক পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলা। রীতি অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি মেলা শেষ হওয়ার কথা। তবে এবার প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক। আয়োজনের ত্রুটিও ছিল। ফলে যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। এ অবস্থায় গত কয়েকদিন ধরে মেলার সময় বৃদ্ধি ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রকাশকরা। আর তারপর বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। সোহ্ওরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান সমিতির সভাপতি ওসমান গনি। বক্তব্য রাখেনÑ দেশের খ্যাতিমান প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদ, মফিদুল হক, আলমগীর হোসেন প্রমুখ। সমিতির নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক, ফরিদ আহমেদ, আফজাল হোসেনসহ অন্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে মেলার সময় এক সপ্তাহ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়। সেইসঙ্গে আয়োজক বাংলা একাডেমির কাছে চাওয়া হয় ক্ষতিপূরণ। বক্তারা বলেন, এটি বাঙালীর প্রাণের মেলা। সকল ভয়কে জয় করে এখানে প্রতিদিনই আসছেন পাঠক। তবে আতঙ্কে ভুগে আসতে পারেননিÑ এমন বইপ্রেমীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ফলে আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। বাংলা একাডেমির সীমাবদ্ধতা ও আয়োজনে নানা ত্রুটির কারেণও সোহ্ওরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়। একাডেমি বরাবর প্রস্তাব করে মফিদুল হক বলেন, ‘সহিংসতার বিরুদ্ধে বই’ এ সেøাগানে আরও সাত দিন মেলা অনুষ্ঠিত হতে পারে। উদ্যোগটিকে অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশকদের প্রতিবাদও বলা যায়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ মেলা শেষ করা হলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিবস মেলার সঙ্গে যুক্ত হবে বলেও জানান তিনি। ব্যবসায়িক দিকটিও বিশেষ প্রাধান্য পায় সংবাদ সম্মেলনে। অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম বইকে পণ্য দাবি করে বলেন, আমাদের লগ্নিকৃত অর্থ তো ফেরত পেতে হবে। কেউ কেউ বাণিজ্য মেলার সময় বাড়িানো হয়েছে উল্লেখ করে একুশের মেলার সময় বৃদ্ধির দাবি জানান। ভবিষ্যতে মেলা আয়োজনের দায়িত্বও প্রকাশকরা নিতে চান বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। তবে মেলার সময় বাড়ানোর বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন অনেক প্রকাশক। তাঁদের বক্তব্যÑ মেলার সময় বাড়ানো হলে বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি লাভবান হবে। আর ছোটরা আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রকাশক বলেন, একুশের মেলা তো বই বিক্রির জন্য নয় শুধু। বই প্রদর্শনীর এটা বড় সুযোগ। সুযোগটি যতটা সম্ভব আমরা কাজে লাগিয়েছি। নানা কারণেই আমাদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এ অবস্থায় সময় বাড়ালে আমাদের আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনেক বড় একটি আয়োজন। চাইলেই এর সময় বাড়ানো যায় না। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। বাস্তব কারণেই মেলার সময় বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। ১৩৪ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৬তম দিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১৩৪টি। ৮টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বৃহস্পতিবার গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘গত বছরে বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রেজাউদ্দিন স্টালিন। সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা কবিতার জন্মের হাজার বছর পর বাংলাদেশের বাংলা কবিতা ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার “সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর” নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই কবিতা একই সঙ্গে সমষ্টির মাত্রা ও ব্যক্তির মাত্রা অভিন্ন চৈতন্যে ধারণ করে। আবহমান বাংলা কবিতার সঙ্গে এই স্বতন্ত্র শিল্পস্বভাবের সম্পর্ক অস্তিত্বগত, রীতি ও প্রকরণগত; কিন্তু চরিত্রগত নয়। বিতর্কের অবকাশ রেখেও বলা যেতে পারে, শহীদের আত্মদান ও রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে যে নবচৈতন্যবাহী কবিতার জন্ম, উনিশ খতকের উপনিবেশিত মধ্যবিত্তের সৃষ্ট কবিতা থেকে তার চরিত্র ভিন্ন হতে বাধ্য। তবুও কবিতা ব্যক্তিচেতনা-উৎসারিত এবং আদি-অনাদির মানবচৈতন্যের অন্তর্ময় সম্পর্কসূত্র। কাললগ্ন হয়েও সে কালাতিক্রমী- রক্তাক্ত সময়গর্ভে বসেও সে সম্মুখগামী। মহাকালের গর্ভ থেকে এক বিন্দু সময়কে যদি আমরা বিচ্ছিন্ন করে সেই সময়ের কবিতার পাতা উল্টাতে থাকি, সেখানেও দেখবো সে একই সঙ্গে সম্মুখগামী এবং অতীতস্পর্শী। আলোচকরা বলেন, গত বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে সব কবিতা রচিত হয়েছে, তার চারিত্রলক্ষণ বিচার করতে গেলে সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিকেও মাথায় রাখতে হবে। গত বছরের পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এবং ছোট কাগজে আশি ও নব্বই-এর দশকের কবিদের সৃষ্টিশীল উপস্থিতির পাশাপাশি নতুন শতাব্দীর তরুণপ্রাণ কবিরা যুক্ত করেছেন চেতনার নতুন নতুন মাত্রা। গত বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও কবিতার শব্দমালা থেকে আমরা এক অবিনাশী জীবনচেতনাকেই যেন খুঁজে পাই। সভাপতির বক্তব্যে কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা ও কবিতা এক অভিন্ন চেতনার উৎসারণ। সাম্প্রতিক কবিদের কবিতায় দুঃসময়-অতিক্রমী আলোর দিশা কতটুকু প্রজ্জ্বলিত তা দিয়েই গত বছরের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, কবিরাই পারে দুঃসময় থেকে মানুষকে সুসময়ের স্বপ্ন দেখাতে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী অমিয় বাউল, খগেন্দ্রনাথ সরকার, বাবু সরকার, মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া, রহিমা খাতুন, পল্লবী সরকার মালতী, মোঃ মিলন, সুধীর ম-ল, বিমল বাউল, জাকির জাফরান এবং আব্দুল আলীম। একাডেমি চত্বরে বর্ণমালা ॥ বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের পেছনে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে বিশেষ ভিড়। বই কেনার পাশাপাশি এখান থেকে সংগ্রহ করা যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের বিশেষ প্যাকেজ। মাত্র ৫০ টাকায় বর্ণমালা নামের সিম কিনতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন গ্রাহক।
×