‘মানুষ বাড়ে বছর বছর জমি তো আর বাড়ে না’- গ্রামবাংলায় বহুল প্রচলিত এই লোক গানের মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য কথাটি উচ্চারিত হয়েছে। জীবনযাপনের ধারাবাহিকতায় জনসংখ্যা বেড়ে চললেও কৃষি জমি বাড়ছে না এক ইঞ্চিও। জনসংখ্যার আধিক্যে উন্নয়ন কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ছে- অর্থনীতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। আর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধির ওপর।
দেশে কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। দ্রুত নগরায়ন, শিল্প ও আবাসন গড়ে ওঠায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে নগরায়নে। শিল্প কারখানা ও নানারকম স্থাপনায় গত এক-দেড় দশকে এই চিত্র ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেসরকারী গবেষণায় এর নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা কৃষি জমিতে গড়ে ওঠা নগরায়ন, শিল্প কারখানা গড়ে ওঠাকে জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকি বলে মনে করছেন। কৃষিবিদরাও একই অভিমত ব্যক্ত করে এর সঙ্গে শঙ্কার দিকটি তুলে ধরে বলছেন, দেশের কৃষি জমির এই অপব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করতে না পারলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না- লাখ লাখ কৃষিজীবী বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় ভূমি ব্যবহার কমিটির প্রথম বৈঠকে শেখ হাসিনা এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ভূমির সুষ্ঠু ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য একটি পৃথক সংস্থা গঠন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি কৃষি জমিতে কোনভাবেই যাতে কোন শিল্প ও আবাসন গড়ে উঠতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে সংশ্লিষ্টদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবাদী জমিতে শিল্পাঞ্চল, শিল্প কারখানা, বিনোদন কেন্দ্র, আবাসন গড়ে ওঠার অশুভ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় না রেখে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনায় দেশের হাজার হাজার একর কৃষি জমি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশের কোন কোন অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরের নামে লাখ লাখ একর কৃষি জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে। লবণাক্ত পানির কারণে জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পতিত।
পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশে কৃষি জমি সংরক্ষণে কঠোর বিধিবিধান মেনে চলা হয়। একই সঙ্গে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সেখানে এক জমিতে বহু ফসল উৎপন্নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। অথচ আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অর্থলিপ্সুদের দখলে। এই লোভাতুর শ্রেণীর হাত থেকে পুকুর, জলাশয়, পাহাড়, নদী-খাল-বিলও রেহাই পাচ্ছে না। এসব ভরাট করে তারা বসতি, শিল্প কারখানা গড়ে তুলছে। এর ফলে আজ পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে।
এই বৈঠকে পল্লী অবকাঠামো বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে পরিকল্পিত আবাসন, গড়ে তুলতে ‘গ্রাম উন্নয়ন আইন’ শীর্ষক একটি নতুন আইন প্রণয়ন এবং শহর উন্নয়ন আইনের কঠোর বাস্তবায়ন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করা হয়। বৈঠকে আবাসন এবং শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের আগে ভূমির অঞ্চলভিত্তিক নক্সা (জোনিং ম্যাপস অব ল্যান্ড) তৈরি করতে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি সড়ক, মহাসড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে যথাসম্ভব উর্বর কৃষি জমি এড়িয়ে অঞ্চল বিভাজন আইন জোনিং ল প্রণয়নের প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়।
অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, দেশের উর্বর কৃষি জমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কোন ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে। যদি তা না করা হয় তাহলে দেশের কৃষি জমির পরিমাণ কমে গিয়ে তৈরি করবে কৃষি বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পড়তে হবে গভীর এক সঙ্কটে। কী কেউ তা চাই? নিশ্চয়ই নয়।
শীর্ষ সংবাদ: