ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

এ দুঃখ রাখব কোথায়?

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১ মার্চ ২০১৫

এ দুঃখ রাখব কোথায়?

আমি ভাষাহীন। মেনে নিতে পারছি না আমাদের সেই অতি পরিচিত আভিজিৎ রায় আর নেই। যে দেশের মানুষের মঙ্গল আকাক্সক্ষা নিরন্তর যাকে তাড়া করেছে, মানুষ আর মানবতার সেবা ছিল যার জীবনের প্রধানতম ব্রত, যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসকারী হয়েও যিনি মাতৃভূমিতে এসেছিলেন হৃদয়ের টানে, তিনি কিনা নৃশংসভাবে নিহত হলেন তারই প্রিয় দেশের মানুষরূপী পশুদের হাতে। তার জন্মদিনেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে এক অবর্ণনীয় জিঘাংসার শিকার হয়ে। মারাত্মকভাবে জখম তার স্ত্রী, যিনি স্বামীকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন, তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আমার সঙ্গে অভিজিতের যোগাযোগ হয় ২০০০ সালে যখন সে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরেটের জন্য অধ্যয়ন করছিল। ওরই অনুরোধে আমি মুক্তমনা ব্লগে লেখা শুরু“করি। ঐ ব্লগে ইংরেজী এবং বাংলা উভয় বিভাগেই আমার নিবন্ধ-পাতা ছিল। এ ব্লগে উপমহাদেশের বাইরে বসবাসকারী বহু দক্ষিণ এশিয়া মুক্তমনা চিন্তাবিদরা নিয়মিত তাদের চিন্তার ফসল অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। মুক্তমনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০০ সালে একটি প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নির্মাণে যে বিষয়গুলো পরম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে সমালোচনামূলক বিতর্কের মাধ্যমে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে, যে বিষয়গুলো সাধারণত মূলধারার বাংলাদেশী এবং দক্ষিণ এশিয়ার মিডিয়াতে উপেক্ষা করা হয়। ২০০১ সালের ২৬ মে অভিজিত মুক্তমনা নামে একটি ইয়াহু গ্রুপ তৈরি করে। এক বছর পর এটা একটা একটি সম্পূর্ণ ওয়েবসাইট (িি.িসঁশঃড়-সড়হধ.পড়স) রূপান্তরিত হয়, যেটা সম্ভবত প্রথম দক্ষিণ এশীয় হিউম্যানিস্ট এবং যুক্তিবাদী ফোরাম ছিল। অভিজিতের নিজের ভাষায় এর উদ্দেশ্য ছিল, ‘এমন একটা কুসংস্কারমুক্ত সমাজ তৈরি করা যেখানে অবাধ কর্তৃত্ব, কুসংস্কার বা শ্বাসরোধী গোঁড়ামির দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে না, বরং যুক্তি, সহানুভূতি, মানবতা, সমতার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।’ এর প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকেই, মুক্তমনা অনেক বিশিষ্ট লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং বিশ্বের সব কোন থেকে মানবাধিকার কর্মীদেরসহ অনেক সদৃশ্যমনা চিন্তাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ গ্রুপটি সবসময় মানুষের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার যখন আক্রান্ত হয়েছে, সেটা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, সবখানেই তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত করার প্রয়াসে প্রয়াসী হয়েছে। মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী হিসেবে সার্বজনীন চিন্তার বাইরেও, অভিজিৎ ১৯৭১ সালে আমাদের জনগণ এবং জাতির উপর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের ব্যাপারে অভিজিত ছিল এক একনিষ্ঠ, অকুতোভয় এবং নিরলস সৈনিক। উদাহরণস্বরূপ, গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল সময়ে সে তার ফেসবুকের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস করা হাজার হাজার বাঙালীর মাঝে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার সেই বহুল পঠিত লেখা ‘কাদের মোল্লাকে নিয়ে আমার দেশ পত্রিকার আষাঢ়ে কাহিনী’ ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটা ছিল এরকমÑ ‘কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের পর পরই ‘আমার দেশ’সহ কিছু মুখচেনা পত্রিকা নানা ধরনের মিথ্যাচার শুরু করে। আবদুল কাদের মোল্লা নাকি রাজাকার নন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। তিনি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরাট ভক্ত। ... আরও কত কি! সম্প্রতি কাদের মোল্লাকে নিয়ে মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দিয়েছেন তারই একজন সহপাঠী ড. মোজাম্মেল এইচ খান। আমার দেশের মিথ্যাচারকে তিনি আগাগোড়া খণ্ডন করে দিয়েছেন, পড়ুন তাঁর লেখা লেখাটা অবশ্যপাঠ্য।’ আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে অভিজিত লিখেছিল, “আমার বন্ধু তালিকায় অনেকেই হয়ত ড. মোজাম্মেল এইচ খানকে সেভাবে চেনেন না। তিনি বহুদিন ধরেই দেশের বাইরে, কিন্তু দেশের মানুষের জন্য তার টান যায়নি। কানাডায় অধ্যাপনার পাশাপাশি মানবাধিকার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। ডেইলি স্টারে নিয়মিত কলাম লিখছেন অনেকদিন ধরেই, সবসময়ই তাঁকে দেখেছি প্রগতির পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিরলসভাবে লেখালেখি এবং কাজ করে যেতে। তিনি একসময় মুক্ত মনাতেও অনেক লিখেছেন।” পরে সে নিজেই কাদের মোল্লাকে নিয়ে এক সুন্দর অনুসন্ধিৎসু নিবন্ধ লেখে যার শিরোনাম ছিল : “কাদের মোল্লার আসল নকল : একটি নির্মোহ অনুসন্ধান” যেখানে সে আমার জনকণ্ঠে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছিল। এমনকি কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আমি ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেয়েছিলাম সেটাও উল্লেখ করেছিল। আর সেটা ছিল এরকম : “বিদায় এককালের সহপাঠী কাদের মোল্লা। তোমার এ পরিণতিতে আমি শোক করতে পারছি না, যেহেতু আমি আমার দেশকে ভালবাসি। শান্তি দিতে চাই ৩০ লাখ শহীদের আত্মাকে।” বাংলাদেশে মুক্তচিন্তাবিদদের বিপদ সম্পর্কে অভিজিৎ সম্যক অবগত ছিল। তাঁর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সে লিখেছিল : “দেশে মুক্তচিন্তার প্রেক্ষাপট কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। মুক্তমত প্রকাশের জন্য হুমায়ুন আজাদকে আক্রান্ত হতে হয়েছে, তসলিমা নাসরিনকে নিগৃহীত হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে আর রাজীব হায়দারকে (থাবা বাবা) অঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র নিপীড়ক এবং হত্যাকারীদের হাতের পুতুল হয়ে থেকেছে বরাবরই। দেশের বাইরে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে ঠিক এমনটি নয়। বিশ্বাসের জন্য কাউকে প্রাণ দিতে হয় না, কিংবা হলেও রাষ্ট্রযন্ত্র হত্যাকারীকে রক্ষায় সচেষ্ট হয় না, বরং হয় সঠিক বিচারের ব্যাপারে উদ্যোগী।” হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অভিজিৎ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিল : “আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশপাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু-বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িড়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।” হায়রে দেশ আমার, এমন একজন পাণ্ডিত্যে ভরা মানবতাবাদীকে তাঁর নিজের মাতৃভূমিতে এসে মানুষরূপী পশুদের হিংস্রতার বলিকাষ্ঠের শিকার হতে হলো। এ দুঃখ রাখব কোথায়? এ জঘন্য শোকাবহ হিংস্রতা আবার আমাদের মানসপটে নিয়ে আসে আমাদের আর এক মহান চিন্তাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর নিপতিত বিয়োগান্ত নাটকের ভয়ানক অনুস্মারকের বীভৎস স্মৃতি। অনুচ্চারিত মাত্রার এই বিয়োগান্ত অঘটন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমরা এখনও গোঁড়ামি আর ধর্মান্ধতার কোন অন্ধকার একটি যুগের মধ্যে বসবাস করছি। এখনও যদি কেউ গলা উঁচিয়ে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রতাবাদের বিপদকে হাল্কা করে দেখার চেষ্টা করেন এবং বলার চেষ্টা করেন এটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের এক রাজনৈতিক সেøাগান তাহলে এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে? এ মানুষরূপী হিংস্র পশুদের হাতে অভিজিতের মতো এক তরুণ এবং উজ্জ্বল মানবতাবাদীর বিয়োগান্তক মৃত্যু সমস্ত জাতির বিবেকের কাছে সেই প্রশ্ন আবারো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে প্রশ্ন অধ্যাপক আজাদ উত্থাপন করেছিলেন : “আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?” লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার এবং দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তমনার লেখক
×