ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৪ জঙ্গী গ্রেফতার

চট্টগ্রামে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান ॥ ৭৬ বোমাসহ বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১ মার্চ ২০১৫

চট্টগ্রামে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান ॥ ৭৬ বোমাসহ বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কক্সবাজার শহরের উশু একাডেমি নামের একটি ঠিকানা ব্যবহার করে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার নীলনক্সা তৈরি করেছে জঙ্গীরা। এই জঙ্গীদের মধ্যে মহিলা সদস্যও রয়েছে। প্রশিক্ষণের সনদও দেয়া হয় ওই একাডেমি থেকে। এ পর্যন্ত প্রশিক্ষিত হয়েছে প্রায় ৮ হাজার। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এদের রয়েছে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। এ ঘটনার পর কক্সবাজারে উক্ত একাডেমির কোন হদিস মেলেনি। র‌্যাবের ধারণা, ঠিকানা গোপন রেখে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণের এ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। শনিবার সকালে চট্টগ্রামের হালিশহরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বিএ ভবন থেকে র‌্যাব সেভেনের সদস্যরা ৪ জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। ৬ তলা এ আবাসিক ভবনে গত দু’মাস আগে তারা অবস্থান নিয়ে শক্তিশালী তাজা বোমা তৈরিসহ নানা ধরনের জঙ্গী হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছে এ ভবনে। জঙ্গীদের গ্রেফতারের ঘটনার পর র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঢাকা থেকে ছুটে আসেন চট্টগ্রামে। ঘটনাস্থলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গীদের আটক, বোমা উদ্ধার এবং বোমা বানানো সম্পর্কে অবহিত করেন। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং যারা জড়িত তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে। র‌্যাব সূত্র জানায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গী হামলার নীলনক্সা তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী থেকে গ্রেফতার হওয়া ১২ জঙ্গীর তথ্য মতে বাঁশখালির লটমনি পাহাড় থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রসহ ৫ জঙ্গীকে গ্রেফতারের ঘটনার মধ্য দিয়ে হালিশহরের এ বাড়ির সন্ধান পায় র‌্যাব। শুক্রবার রাত থেকেই ভবনের চারদিকে নজরদারি বাড়িয়ে র‌্যাব সদস্যরা শনিবার সকালে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে র‌্যাব সদস্যরা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত হালিশহর থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১৮নং সড়কের বিএ ভবনের দিকে কড়া নজরদারির পর এক মহিলাসহ ৪ জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলোÑ কক্সবাজারের মগনামার পেকুয়া এলাকার মাওলানা আবুল কালামের ছেলে ফয়জুল হক ও মেয়ে রহিমা আক্তার, বাগেরহাটের মোরলগঞ্জের আবদুর রাজ্জাকের পুত্র আবদুল হাই ও জাহেদুল আলম জাহেদ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭৬টি তাজা বোমা, ৩০ প্রকারের বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ১৫০ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ২৪ রাউন্ড শর্টগানের গুলি, বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি, ভাল্ব, তার, ভাঙ্গা কাচ ও বেশকিছু জিহাদী বই। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, বোমা তৈরি ও নাশকতামূলক কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সক্রিয় রয়েছে। বোমা তৈরি থেকে উপকরণ সংগ্রহ এবং অর্থের যোগানও রয়েছে তাদের। গত দু’মাস আগে তারা এ ভবনটির দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়েছে। ভবনটির এক ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া সূত্রে জানা গেছে, এ বাড়ির মালিক যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর ধরে তারা এ বাড়িতে রয়েছেন। গত দু’মাস আগে ৫ বেডের দ্বিতীয় তলার বাসাটি গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা ভাড়া নিয়েছে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার কথা বলে। তবে ফ্ল্যাট বাড়ি হওয়াতে সকলেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে বিধায় কে কোন কাজে লিপ্ত তা দেখার সুযোগ নেই। এ সুবাদে দ্বিতীয় তলায় পরিবারের মালামালের গাড়িতেই বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির সরঞ্জাম আনা হয়েছে বলে তার ধারণা। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৬ বস্তাভর্তি স্টেনলেস স্টিলের প্রায় ৬ ইঞ্চি পরিমাণের কাটা পাইপ, পানির পাইপের দেড় ইঞ্চি পরিমাপের চকেট, এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পানির বোতল প্রায় ২শ’টি, বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির জন্য বোতল, বোমা তৈরির পাউডার, গান পাউডার, জিংক, দস্তা, কাচ, পটাশসহ নানা উপকরণ। এসব উপকরণ দিয়ে হাজার হাজার বোমা তৈরির প্রস্তুতি ছিল এ জঙ্গী সংগঠনের। এদিকে র‌্যাব সদস্যরা ওই ভবন থেকে বেশকিছু জিহাদী বই, লিফলেট ও প্রশিক্ষণ সনদ উদ্ধার করেছে। প্রশিক্ষণ সনদের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারের উশু নামের একটি একাডেমি সার্টিফিকেটও পাওয়া গেছে এ বাসায়। ২০১০ সালে কক্সবাজারের বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম সংলগ্ন লং টেনিস মাঠে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে এ সনদ অনুযায়ী গত নবেম্বর থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসব্যাপী জঙ্গী প্রশিক্ষণের ওপর ডিপ্লোমা কোর্স প্রদান করা হয়েছে। সিলেটের হবিগঞ্জস্থ বাহুবল এলাকার মোঃ খালদুনুল ইসলামের ছেলে হাম্মাদুনের সনদসহ বেশ কয়েকটি সনদ পাওয়া গেছে এখানে। সিদ্দিকুল ইসলাম নামের কক্সবাজার উশু একাডেমির প্রধান কোচ স্বাক্ষরিত। তিন মাসব্যাপী এ প্রশিক্ষণে জঙ্গীরা তাদের ভাষায় চানচুয়ান, দাউসু, গুনসু, জিয়ানসু, জিয়াংসু, নানসুয়ান, নান্দাও, নানগুন, তাইসিসুয়ান, তাইসি জিয়ান ও চানসা নামক বিভিন্ন ইভেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ের ওপর দেড় শ’ জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদান করা হয়েছে গত ২০ ফেব্রুয়ারি। র‌্যাবের মহাপরিচালক প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও বলেন, দেশব্যাপী নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে আমরা সচেষ্ট রয়েছি এবং জনগণকে সচেতন করতে ও নাশকতাকারীদের তথ্য উদঘাটনে র‌্যাবের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকু-, মীরসরাই, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাবের ফোন নাম্বারও দেয়া হয়েছে। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স টিম এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা টিম সে অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালির লটমনি পাহাড়ে অভিযান চালায়। ওই পাহাড়ের পাদদেশে ও চূড়ায় গরুর খামারের আড়ালে চালাচ্ছে জঙ্গী প্রশিক্ষণ। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই ওই স্থানে অভিযান চালানো হয়। সেখানে মাটির নিচে রাখা প্লাস্টিকের ডামে তিনটি একে-২২ রাইফেল, ছয়টি বিদেশী পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি দেশীয় তৈরি বন্ধুক, একে-২২ রাইফেলের ম্যাগজিন, নয়টি পিস্তলের ম্যাগজিন, ৭৫১ রাউন্ড গুলি, তিনটি চাপাতি, দুটি ওয়াকিটকি, কংফু বা মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের সরঞ্জামাদি, ১৪ জোড়া জঙ্গল বুট, ২ জোড়া সেনা বুট, ৪ জোড়া পিটি সু, পাঁচটি টর্চ লাইট, ৩৮ সেট প্রশিক্ষণ পোশাক উদ্ধারসহ ৫ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়।
×