ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিজিৎ হত্যায় জাতিসংঘের গভীর উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১ মার্চ ২০১৫

অভিজিৎ হত্যায় জাতিসংঘের গভীর উদ্বেগ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সাম্প্রদায়িক বিরোধী লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ড. অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা ও স্ত্রীকে আহত করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) হত্যাকা-টির তদন্তে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তরফ থেকে এফবিআইয়ের সহায়তা চাওয়া বা পাওয়ার আগ্রহের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। এদিকে শনিবার বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাসের তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল অভিজিতের পিতার বাসায় প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছে। বৈঠকে হত্যাকা-ের সার্বিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা হয়। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে তদন্তে সহায়তা করতে মার্কিন সরকার প্রস্তুত বলে প্রতিনিধি দলের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এদিকে হত্যাকা-ের ঘটনায় শনিবার রাত আটটা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। দুই যুবক সরাসরি হত্যাকা-টি ঘটায়। হত্যার আগে ওই যুবকরা ঘটনাস্থলের পাশেই একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল। হত্যাকারী দুই যুবককে সহায়তা করতে কিলিং মিশনে কতজন ছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। এজন্য অমর একুশে বইমেলার অন্তত ৭০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের কাছেই অভিজিৎ রায়কে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বাধা দিতে গিয়ে আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রাফিদা আশঙ্কামুক্ত। এ ঘটনায় ২৭ ফেব্রুয়ইর নিহত অভিজিতের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার রায় শাহবাগ মডেল থানায় অজ্ঞাত খুনীদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে শফিউর রহমান ফারাবী। অভিজিৎ হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ফারাবীর পক্ষ থেকে এটিকে একটি সফলতা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্বেগ ॥ লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা-ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ ঘাতকদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার প্রত্যাশা জানিয়েছে। শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফানে ডুজারিক এ কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, মানবাধিকার দেখভালের দায়িত্বে থাকা সহকর্মীদের সঙ্গে জাতিসংঘ ব্লগারদের ওপর হামলার বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। বাংলাদেশে সুশীল সমাজের মতো প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করে তাঁরা। এদিকে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র জেন সাকি এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা-কে কাপুরুষোচিত। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। বাংলাদেশ চাইলে এ হত্যাকা-ের তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। যুক্তরাষ্ট্র বিধি মোতাবেক কনস্যুলার সহায়তা দেবে। মার্কিন দূতাবাস প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অভিজিতের পিতার বৈঠক ॥ অভিজিতের পৈশাচিক হত্যাকা-ের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। হত্যাকা-ের ঘটনা দেশটির সংবিধানের ওপর আঘাত বলে মনে করে। অভিজিৎ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় সেদেশ হত্যাকা-ের তদন্তে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মামলা তদন্তের আগ্রহের বিষয়ে কথা বলতে শুক্রবার রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই (ভেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)-এর কেন্দ্রীয় অফিস থেকে অভিজিতের পিতাকে টেলিফোন করা হয়। টেলিফোনে এফবিআই মামলাটির তদন্তে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি জানানো হয় অভিজিতের পিতাকে। মামলা তদন্তে অভিজিতের পিতার ইচ্ছার বিষয়েও জানতে চাওয়া হয় এফবিআই-এর তরফ থেকে। অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে তদন্তে সহায়তা করলে, কোন আপত্তি নেই বলে অভিজিতের পিতা এফবিআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান। এক্ষেত্রে অভিজিতের পিতা বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এফবিআইকে যোগাযোগ করার কথা বলেন। বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই সে কাজটি করবে বলে এফবিআই কর্মকর্তারা জানান। তারই প্রেক্ষিতে শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাসের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অভিজিতের পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিনিধি দলটি সরাসরি অভিজিতের পিতা অজয় রায়ের রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ১০২-১০৪ নম্বর বাড়ির ২/এফ নম্বর বাসায় যান। প্রতিনিধি দলে মার্কিন দূতাবাসের দুইজন উর্ধতন কর্মকর্তা এবং একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা ছিলেন। প্রতিনিধি দলটি প্রায় দুই ঘণ্টা অভিজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রতিনিধি দলটি অভিজিৎ রায়ের বংশধর, পুরো পরিবারের সদস্যের পড়াশুনা, গ্রামের বাড়ি, অভিজিৎ রায় কবে দেশে এসেছেন, কেন এসেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় কি করেন, কবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তার স্ত্রী কি করেন, প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আগাম অবহিত করা হয়েছিল কিনা, কোন এয়ারলাইন্সের কত নম্বর বিমানে এসেছেন, তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বই, সেইসব বইয়ে কি লেখা আছে, কোন কোন বিষয়ের উপর লেখা, অভিজিতের প্রাণনাশের তরফ থেকে অভিজিৎ বা তার স্ত্রী বা তাঁর পিতামাতার তরফ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা বাংলাদেশের কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করা হয়েছিল কিনা, এমন হত্যাকা-ের পর অভিজিতের পিতামাতা বা তাদের নিকটাত্মীয়রা আতঙ্কিত কিনা, এমন হাজারো বিষয়ে জানতে চান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। যতদূর সম্ভব বিস্তারিত বিষয়াদি প্রতিনিধি দলকে অবহিত করা হয় অভিজিতের পরিবারের তরফ থেকে। প্রতিনিধি দল এসব বিষয়টি লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করে নেন। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মামলাটির তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে জানায়। এ ব্যাপারে অভিজিতের পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, অভিজিৎ যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিল, সে কারণে সেদেশটির সরকার হত্যাকা-ের তদন্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করতেই পারে। মামলার তদন্তে আগ্রহ দেখিয়ে বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাসের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তাঁর বাসায় এসেছিলেন। তদন্তকারী সূত্র দাবি করেছে শনিবার রাত আটটা পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজন চা দোকানী, ফুচকা বিক্রেতা, ভাসমান দোকানী রয়েছে। হত্যাকারী হিসেবে দুইজনের কথা এসেছে। তাদের বয়স ২৫ থেকে ২৬ বছর বয়সী। তাদের পরনে আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ ছিল। হত্যার পর খুনীদের একজন টিএসসির দিকে এবং অপরজন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বই মেলার দিকে চলে যায়। তবে পুরো কিলিং মিশনে কতজন ছিল তা নিশ্চিত করা যায়নি। হত্যাকা-ের ধরন পর্যালোচনা করে তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, অভিজিৎ রায় বাংলাদেশে আসার পর থেকেই হত্যাকারীরা তাকে অনুসরণ করছিল। অভিজিৎ বইমেলার যেসব জায়গা দিয়ে ঘোরাফেরা করেছেন কিলিং মিশনের সদস্যরা তাদের অনুসরণ করেছে। হয়ত একাধিক অনুসরণকারী অভিজিতের ওপর নজর রাখছিল। মূল হত্যাকারীরা সুযোগ বুঝে অভিজিৎকে হত্যা করে। অনুসরণকারীদের শনাক্ত করতে বইমেলার ৭০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহিত ফুটেজ পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য অনুসরণকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এদিকে সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে অভিজিতের মগজের কিছু অংশ, রাফিদার বাম হাতের কেটে পড়ে থাকা বৃদ্ধাঙ্গুল, চশমা, পার্স ও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে মামলার আলামত হিসেবে সংরক্ষণ করে। আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আবারও সরেজমিনে ঘটনাস্থল ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি লাগোয়া ঘটনাস্থলটি সোহ্রাওয়াদী উদ্যানের গেট থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ গজ অদূরে। শাহবাগের দিকে। ঘটনাস্থলের আশপাশে অন্তত এক হাজার গজের মধ্যে কোন সিসি ক্যামেরা নেই। এমনকি টিএসসি, হাকিম চত্বর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর বাইরে কোন সিসি ক্যামেরার অস্তিত্ব ছিল না। হত্যাকারীরা আবছা অন্ধকারে অভিজিৎকে হত্যার পর নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অথচ ঘটনার অদূরে সোহরাহওয়ার্দী উদ্যান ও মিলন চত্বরে সর্বক্ষণিক পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছিলেন। মাত্র এক থেকে দুই মিনিটে অপারেশন শেষ করে পালিয়ে যায় হত্যাকারীরা। অভিজিতের পিতা অজয় রায় নিহতের স্ত্রীর বরাত দিয়ে জানান, হত্যাকারীরা দুইজন ছিল। তাদের যে রাস্তা দিয়ে অভিজিৎ স্ত্রীসহ হেঁটে গেছে, সেই রাস্তার পাশেই একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল। হত্যাকারীদের বয়স ২৫ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। তাদের পরনে আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ ছিল।
×