ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেমিনারে আইসিসির ডেপুটি প্রসিকিউটর জেমস স্টুয়ার্ট

একাত্তরের গণহত্যার বিচার অবশ্যই করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২ মার্চ ২০১৫

একাত্তরের গণহত্যার বিচার অবশ্যই করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশে গণহত্যার বিচার চালিয়ে যেতে হবে। সকল গণহত্যার বিচার শেষ করেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। ‘বাংলাদেশে গণহত্যা ও ন্যায়বিচার’-শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের শেষে বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এই যৌথ ঘোষণা দেন। এদিকে সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সমালোচনা করে বলেছেন, ১৯৭১ সালে যারা গণহত্যা ঘটিয়েছে তাদেরই মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্র। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তিন দিনব্যাপী এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারের শেষ দিন ছিল রবিবার। এদিন চারটি অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন। সেমিনারের সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তেব্য প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশে এমন কোন পরিবার নেই, যার কোন সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হয়নি। এজন্য আমরা ১৯৭১ সালের গণহত্যা, বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ ভুলতে পারি না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি যেসব পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বজন হারিয়েছে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার চেয়ে, যারা গণহত্যা ঘটিয়েছে তাদের মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্র। দেশে যুদ্ধাপরাধের ট্রাইবুন্যাল স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে- যুক্তি তুলে ধরে ড. গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যেমন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তেমনি এই অপরাধের বিচারে গঠিত আদালতও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ’৭১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রায় চার দশক পর বিচার পাচ্ছে। সেমিনারে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক একটি যৌথ ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, গণহত্যার ন্যায় ভয়ংকর অপরাধের বিচার পেতে ভুক্তভোগী নাগরিকদের দীর্ঘ প্রায় চার দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এই বিচার চলছে। এই বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। এতে আরও বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে আরও বেশি শিক্ষিত এবং শিক্ষা দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর এই ধরনের অপরাধ সংঘটিত না হয়। সেমিনারে সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, বিভিন্ন দেশে ধর্ম, আদর্শ, জাতিগত বিরোধ কেন্দ্র করে গণহত্যা হয়েছে। গণহত্যা প্রতিরোধে সকল হত্যার বিচার ও মানবতাকে জাগ্রত করতে হবে। মানবতা জাগ্রত করতে না পারলে আমরা অবশ্যই গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হব। ইন্টারন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারের সভাপতি ডেনিয়েল ফেইরিস্টেন বলেন, গণহত্যা প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। কোন দেশে যেন গণহত্যা না ঘটে, সে বিষয়ে সকলকেই সচেতন হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন ধরনের চিন্তা ও আদর্শ চাপিয়ে দেয়ার জন্যও গণহত্যা করা হয়। এসব বিষয়েও লক্ষ্য করা প্রয়োজন। মানবতাকে উর্ধে তুলে ধরে গণহত্যা প্রতিরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে সকল দেশে গণহত্যার বিচার হতে হবে। তাহলেই গণহত্যার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ডেপুটি প্রসিকিউটর জেমস স্টুয়ার্ট বলেন, বিশ্বের দেশে দেশে গণহত্যার বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কাজ করছে। আফ্রিকার ৩৪ দেশ, ইউরোপের প্রায় সবকটি দেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশ আইসিসির সদস্য। আমরা বিভিন্ন দেশের গণহত্যা পর্যবেক্ষণ করছি। তবে মনে রাখতে হবে, গণহত্যা বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে। সেই গণহত্যার বিচার অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে। ভারতের সেন্টার ফর স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের সিনিয়র ফেলো আশিষ নন্দী বলেন, বিভিন্ন দেশে গণহত্যার দুটি রূপ আছে। একটি দৃশ্যমান অপরটি অদৃশ্য। দৃশ্যমান গণহত্যা আমাদের চোখে পড়ছে। তবে অদৃশ্যমান গণহত্যা অনেক দেরিতে হলেও সেটা বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, গণহত্যার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনাও বড় গণহত্যা। এছাড়া ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগের সময়ও গণহত্যা হয়েছে। সেই সময়ে দাঙ্গায় অনেক লোক নিহত হয়। বিশেষ করে পাঞ্জাব ও পূর্ববঙ্গে গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা হয়েছে। এসব গণহত্যার অবশ্যই বিচার হতে হবে। শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী একাত্তরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালে আমার স্বামী ডাঃ আলীম চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারপর থেকেই স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করছি। বঙ্গবন্ধু সরকার একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে তিনি মারা যাওয়ার পরে সে উদ্যোগ আর সফল হয়নি। এরপর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোন সরকারই এই বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমি আশা করছি এই বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটবে। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, আমার বাবা মুনীর চৌধুরীকে হত্যার পর আমি একজন পিতাহীন সন্তান হয়ে যাই। আমার সকল বন্ধুদের পিতারা তাদের স্কুলে নিয়ে যেত। তারা আমাকে বলত তোমার বাবা কোথায়। সেই স্মৃতি আমাকে এখনও কষ্ট দেয়। আমার মতো অসংখ্য সন্তান তার মাতা-পিতাকে ১৯৭১ সালে হারিয়েছে। তাই ’৭১-এর ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যা গবেষক মাইকেল মসকো, আন্দ্রে বার্টোলি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, ডাঃ সারোয়ার আলী, মুক্তিযোদ্ধা নিজামউদ্দিন প্রমুখ। শুক্রবার এই সেমিনারের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেমিনারে বিশ্বের নয়টি দেশ থেকে ১৮ গণহত্যা বিশেষজ্ঞ অংশ নেন।
×