ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোদিকে মমতার চিঠি

তিস্তা নিয়ে ঢাকা-দিল্লী অন্তর্বর্তী চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ মার্চ ২০১৫

তিস্তা নিয়ে ঢাকা-দিল্লী অন্তর্বর্তী চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ তিস্তার জট খুলতে শুরু করেছে। আপাতত দুই দেশ একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি নিয়ে এগোচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে এবার এগিয়ে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। ঢাকা সফর থেকে ফিরে গিয়ে তিনি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে। পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর ঢাকা সফরে আসার আগেই মমতার চিঠি মোদির কাছে পৌঁছায়। ফলে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যত নিয়ে আশার আলো দেখছে দিল্লী। মমতার এই চিঠির পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর কোন বাধা থাকবে না। জানা যায়, তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্তত ১০ বছরের জন্য অন্তর্বর্তী চুক্তির পথে এগোচ্ছে ভারত। প্রয়োজনে এই মেয়াদ বাড়ানোও হতে পারে। তবে কোন্ দেশ কতটা পানি পাবে পরবর্তীতে তা আলোচনা করে ঠিক করা হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে স্থল সীমান্ত চুক্তির পাশাপাশি এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা রয়েছে। সব ঠিক থাকলে এপ্রিল মাসেই ঢাকা সফরে আসতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কয়েকদিনের মধ্যেই এ নিয়ে চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানাবে ভারত সরকার। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করের হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন মোদি। চিঠিতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সফরের জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। মোদি হাসিনাকে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ঢাকায় আসতে চান। ১৯৯৬-এর ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে হাসিনার সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তির সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে সঙ্গে রেখেছিলেন, তিস্তা চুক্তিতেও মমতাকে ঠিক একইভাবে সঙ্গে নিয়ে চলতে চাইছেন মোদি। এই নীতি মেনেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়াতেও তিনি তামিলনাড়ুকে সঙ্গে রাখছেন। বাংলাদেশ থেকে ফিরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নিজে তাঁর সফরের খুঁটিনাটি জানিয়ে চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর সফর ইতিবাচক হয়েছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ পানির ভাগ নিয়ে দু’পক্ষেরই কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে যে জট পাকিয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমেই কাটিয়ে ফেলা সম্ভব। এ বিষয়ে সহযোগিতার প্রস্তাবও দিয়েছেন মমতা। আগামী ৯ মার্চ মোদি-মমতার বৈঠকেও তিস্তা চুক্তি ও বাংলাদেশসংক্রান্ত বিষয়গুলো উঠবে বলে জানা গেছে। জানা যায়, ঢাকা সফরে মমতা শেখ হাসিনাকে বলেছেন তিনি তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে নন। কিন্তু ইউপিএ জমানায় রাজ্যের সঙ্গে কোন আলোচনা না-করে কেন্দ্র যেভাবে চুক্তিটি করতে চলেছিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। তাই কেন্দ্রের সচিবরা অনেক বুঝিয়েও তাঁকে এ বিষয়ে নরম করতে পারেননি। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তাঁকে বোঝাতে কলকাতায় গেলে তাঁর সঙ্গে মমতার কথা কাটাকাটি হয়। ফলে তিস্তা চুক্তিও বিশ বাঁও জলে চলে যায়। এবারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কলকাতায় গিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলেছেন। দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজেও মমতার সঙ্গে দোভালের বাংলাদেশ নিয়ে কথা হয়। মমতার বক্তব্য, তিস্তার পানির ভাগ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা হোক। এই আলোচনার মাধ্যমেই একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছনো যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, এর আগে ইউপিএ আমলে চুক্তির খসড়া তৈরির সময়ে দেশের নিরাপত্তার যুক্তি তুলে রাজ্যের প্রয়োজনের বিষয়টি খারিজ করে দেয়া হয়েছিল। দিল্লীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এতদিন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাক্যালাপটুকুও সযতেœ এড়িয়ে এসেছেন মমতা। সম্প্রতি মোদির ডাকা নীতি আয়োগের বৈঠকে তিনি নিজে তো যানইনি, রাজ্যের কোন প্রতিনিধিও পাঠাননি। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআইয়ের তদন্তে কোণঠাসা মমতা তাঁর এক সময়ের ডান হাত মুকুল রায়ের বিজেপিতে যোগ দেয়া নিয়ে জল্পনার শুরু হতেই সুর পাল্টেছেন। মোদির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কমানোর চেষ্টাও চোখে পড়ছে। ঢাকা সফরের আগে দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সম্মানে দেয়া প্রণব মুখার্জীর নৈশভোজে মোদির মুখোমুখি হয়েছিলেন মমতা। অনেকের মতে, মোদির সঙ্গে দেখা করতেই সে যাত্রা দিল্লীতে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন তিনি। এর পর অতি সম্প্রতি মোদির সঙ্গে বৈঠকের জন্য তাঁর সময় চেয়েছেন মমতা। এই প্রেক্ষাপটেই তিস্তা নিয়ে মমতার চিঠি তাঁর নরম অবস্থানের আরও একটি উদাহরণ বলে মনে করা হচ্ছে এবং তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যত নিয়েও আশার আলো দেখছে কেন্দ্র। মমতার এই চিঠির পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর কোন বাধা থাকবে না। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু সারদা নয়, খাগড়াগড় কা-ের পরে বাংলাদেশে তাঁর সম্পর্কে যে বিরূপ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে তা কাটানোর লক্ষ্যও মমতার। সেজন্য গোড়ায় তিনি ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তিতে সায় দিয়েছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ঢাকাকে শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাননি, দেশের প্রতিনিধি হিসেবে হাসিনা সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি রূপায়ণের পথ নির্দেশিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। ঢাকার ভারতীয় হাই-কমিশনার পঙ্কজ শরন এই আলোচনায় আগাগোড়া মমতার সঙ্গে ছিলেন। মমতা ঢাকায় থাকাকালীনই এক রকম আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন ভারতীয় হাই-কমিশনার। পরে পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর ঢাকায় এসে নানা বিষয়ের সঙ্গে তিস্তা নিয়েও কথা বলেছেন বাংলাদেশের নেতৃত্বের সঙ্গে। এতদিন দিল্লীর বিরুদ্ধে তিস্তা চুক্তি নিয়ে টালবাহানার হাল্কা নালিশ করে এলেও ঢাকা অতি সম্প্রতি জানিয়েছে, এ বিষয়ে দিল্লীর তৎপরতায় তারা সন্তুষ্ট। দিল্লীর কূটনৈতিক মহলের মতে, মমতা এ বছরেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু, রাজ্য বঞ্চিত হবে এই যুক্তিতে এতদিন মমতা যে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছেন, কোন্ যুক্তি তুলে আবার সেটিকে মেনে নেবেন, তা নিয়ে কৌতূহলী সকলেই। তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা দীর্ঘদিনের। বর্ষার সময়ে পানি থাকলেও সমস্যা নবেম্বর থেকে মে শুকনো মৌসুমে। শুকনো মৌসুমে তিস্তার খাতে কোন কোন সময় পানি থাকে ২০০ কিউসেকেরও কম। এর ২০ শতাংশ পানি আবশ্যিকভাবেই নদী খাতে থাকতে হয়। বাকি পানি ব্যবহার করা যায়। পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে শুকনো মৌসুমে সমস্যা হয়। তখন বাংলাদেশেরও চাহিদামতো পানি পেতে সমস্যা হয়। এসব প্রশ্ন এখনও রয়েছে। কোন্ দেশ তিস্তার কতটা পানি পাবে আগে থেকে তা নির্ধারণ করে দেয়ায় ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী অন্তর্বর্তী চুক্তিতে সম্মতি দেননি। পরে তিনি এ নিয়ে ড. কল্যাণ রুদ্রর নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিশন গঠন করে। তিস্তার খাতে কিভাবে পানির পরিমাণ বাড়ানো যায় তা নিয়ে কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়। এবার বাংলাদেশের কাছে ভারতের তাই প্রস্তাব, চুক্তি হোক অন্তর্বর্তী। অন্তত ১০ বছরের জন্য। পাশাপাশি গঠিত হোক একটি বিশেষ কমিটি। যেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের পানিসম্পদ দফতরের বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। তারাই আলোচনা করে ঠিক করবেন কিভাবে পানি বণ্টন করা যাবে। বর্ষার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে কিভাবে তিস্তা খাতে পানির পরিমাণ বাড়ানো যাবে, তার রূপরেখা তৈরি করবে। এজন্য কী ধরনের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায় তা ঠিক করবে। তার পর কোন্ দেশ তিস্তার কতটা পানি পাবে তা নির্ধারণ হবে। আপাতত হতে পারে পানি বণ্টনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী একটি চুক্তি।
×