ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৌশল পরিবর্তন করছেন খালেদা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৭ মার্চ ২০১৫

কৌশল পরিবর্তন করছেন খালেদা

শরীফুল ইসলাম ॥ রাজনীতি ও আন্দোলনে সময়ে সময়ে কৌশল পরিবর্তন করছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর প্রথম দিকে তিনি বর্তমান সরকারের পতন চেয়েছেন। কিন্তু সরকার পতনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করেন। এর আগেও ২০১৩ সালের ৫মে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সরকারের পতন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন খালেদা জিয়া। আর ইদানিং বিদেশী কূটনীতিকদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্দোলনে খালেদা জিয়া আবারও নতুন কৌশল নিতে পারেন বলে জানা গেছে। এদিকে আন্দোলনে সফলতার জন্য সর্বশেষ কৌশলের অংশ হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে নিপীড়ন-নির্যাতনের অভিযোগ করে তা প্রতিরোধ করতে সারাদেশের পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে সাড়া দেয়নি বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরা। এখন পর্যন্ত দেশের কোন পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠনের খবর পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়টি তাকে ভাবনায় ফেলেছে। এদিকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতি শুক্রবার বিএনপির পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে পরবর্তী সপ্তাহের রবিবার থেকে হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হলেও ৬ মার্চ শুক্রবার দেয়া বিবৃতিতে হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়নি। এটা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কোন কৌশল পরিবর্তনের ইংগিত কিনা তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা চলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি অর্থাৎ এ বছর ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে প্রথমে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার লক্ষ্য ছিল সরকারের পতন। ওইদিন রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকার পতনে লাগাতার আন্দোলনে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে ৩ জানুয়ারি রাতেই বাসা ছেড়ে গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন তিনি। কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে সমাবেশ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু পুলিশী বাধা অতিক্রম করেই ৫ জানুয়ারি বিকেলে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। খালেদা জিয়ার এ ইচ্ছের কথা জেনে দুপুরেই গুলশান কার্যালয়ের ফটকে তালা মেরে দেয় পুলিশ। কিন্তু বিকেলে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে যাওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসলে গুলশান কার্যালয় থেকে পুলিশ বের হতে দেয়নি খালেদা জিয়াকে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী সেøাগানে মুখরিত হয়ে লাথি মেরে তালাবদ্ধ গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে মারে। এর কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়া গাড়ি হতে নেমে ওখানে দাঁড়িয়েই ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেন। রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকার পতনের আন্দোলনে যেতে ব্যর্থ হয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে টানা অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যেই দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী দিতে থাকেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের সফলতার স্বার্থে তিনি গুলশানের কার্যালয় ছেড়ে বাসায় যাচ্ছেন না। এমনকি ১৯ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে শেরেবাংলানগরের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারেও যাননি তিনি। এ ছাড়া বিশ্ব এজতেমার মোনাজাতে অংশ নিতেও তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হননি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি আন্দোলন কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ কর্মসূচী শুরুর আগেই দলের সিনিয়র নেতারা পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। আর খালেদা জিয়া নিজেও গুলশানের বাসা থেকে বের হতে পারেননি। তাই মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী পালন করতে পারেনি বিএনপি জোট। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভ-ুল করতে সারাদেশে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তার এ নির্দেশ কার্যকর না হওয়ায় গত বছর ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। নির্বাচনের পর সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকারও গঠন করে ফেলে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করে সারাবিশ্ব থেকে বাহবা কুড়াতে সক্ষম হয় এ সরকার। এ পরিস্থিতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সরকারের কঠোরতা উপেক্ষা করে আন্দোলন গতিশীল করতে না পেরে এক পর্যায়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালাতে থাকে বিএনপি জোট। এদিকে সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে খালেদা জিয়া যাবেন কি-না বা নির্বাচনের ফলাফল মানবেন কি-না সে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করেননি তিনি। কারণ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার পর এর আগে বিএনপি যে কয়বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যায় তা মেনে নেননি খালেদা জিয়া। এমনকি ৯১-এ বিএনপি নির্বাচিত হলেও ফলাফল প্রকাশের আগে তিনি বলেছিলেন ফলাফল মানবেন না। এমনকি সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে ফলাফল মানবেন না বলেছিলেন। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপি দলীয় প্রার্থী মঞ্জুর আলম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ও তার দল সেই ফলাফল ঠিকই মেনে নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন খালেদা জিয়া ও তার দল। ২০০৬ সালের ২৭ ক্ষমতা ছড়েন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। সে কারণে ২২ জানুয়ারি ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত হয়ে যায়। পরে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এ সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে দলের সংস্কারপন্থী নেতারা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে দল পুনর্গঠন ও নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে গ্রেফতার হন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এরপর দলের সংস্কারপন্থীরা আরও বেশি সক্রিয় হন। ওই বছর ৩ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করে যৌথবাহিনী। ওইদিনই খালেদা জিয়া আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করে স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ করেন। এরপর দলের সংস্কারপন্থীরা স্থায়ী কমিটির সদস্য সাইফুর রহমানকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদকে মহাসচিব করে বিএনপি পাল্টা কমিটি গঠন করেন। এরপর থেকে পৃথক পৃথকভাবে খালেদাপন্থী বিএনপি ও সংস্কারপন্থী বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে থাকে। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওইদিনই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় হয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় চলে যান খালেদা জিয়া। আর ৩ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ১১ সেপ্টেম্বরই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে চলে যান তারেক রহমান। এ পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার চেষ্টা করেও পরে এ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এ নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অনেক আশাবাদী ছিলেন। তাই নির্বাচনের আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন তার দল বিএনপি সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসনের চেয়েও বেশি আসনে বিজয়ী হবেন। কিন্তু নির্বাচনে জনরায় প্রতিকূলে যাওয়ায় পরে তিনি সেবার ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিষয়ে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, সময়ে সময়ে কৌশল পরিবর্তন রাজনীতি ও আন্দোলনের স্বার্থেই করা হয়ে থাকে। তাই কৌশল পরিবর্তন বড় কথা নয়, সফলতা অর্জনই বড় কথা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও রাজনীতি ও আন্দোলনের সফলতার জন্যই কখনও কখনও কৌশল পরিবর্তন করে থাকেন।
×