ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হত্যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দিনভর বিক্ষোভ সমাবেশ অনশন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৭ মার্চ ২০১৫

হত্যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দিনভর বিক্ষোভ সমাবেশ অনশন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হত্যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানালেন হাজারো মানুষ। প্রতিবাদী কণ্ঠ থেকে উগ্র-সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আছড়ে পড়ল তীব্র ক্ষোভ আর বিক্ষোভ। ঘৃণা আর ধিক্কার নিয়ে রাজধানীর শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দিনভর ঢল নামে প্রতিবাদী জনতার। সমস্বরে ডাক দেয়া হলো সন্ত্রাস ও মৌলবাদবিরোধী কঠোর সংগ্রামের। সবাই বললেন, হত্যা করে সন্ত্রাস আর উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। অভিজিৎরা কখনও মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। তাইতো অসাম্প্রদায়িক লেখক অভিজিৎ হত্যা, দেশব্যাপী বিএনপি জামায়াত জোটের নাশকতা, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যার ঘটনাকে ‘না’ বললো প্রত্যেকেই। শুক্রবার দেশবিরোধী সকল কর্মকা-ের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পাঁচ ঘণ্টার গণঅনশন কর্মসূচী পালন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শাহবাগে সভা সমাবেশ করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। টিএসসি এলাকায় সমাবেশ করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে ও জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের দ্রুত ফাঁসির দাবিতে প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান ও আলোর মিছিল কর্মসূচী করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকেও ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়োজন। সাংস্কৃতিক জোট ॥ অশুভ ও অগণতান্ত্রিক সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রতিরোধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রতিগতিশীল ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দেশব্যাপী চলা টানা অবরোধ ও হরতালে সৃষ্ট সন্ত্রাস-নাশকতা-পুরিয়ে মানুষ হত্যা, শিক্ষা ও অর্থনীতি ধ্বংস এবং জঙ্গীবাদী তৎপরতার প্রতিরোধে ৫ ঘণ্টা প্রতীকী অনশন কর্মসূচী পালন করেছেন সংস্কৃতি কর্মীরা। শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলা এই অনশন কর্মসূচীর আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এ সময় তাদের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করে দেশের প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, কৃষিবিদসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় তারা হরতাল অবরোধ ও নাশকতার বিপক্ষে নানা স্লোগান দেন। প্রতিবাদী সঙ্গীত, মঞ্চ নাটক, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়ের মাধ্যমে চলে প্রতিবাদ। তারা দাবি করেন আগুন সন্ত্রসীদের দ্রুত বন্ধ করতে হবে। একটি স্বাধীন দেশে আগুন দিয়ে রাজনীতি করে শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছেও বলে তারা অভিযোগ করেন। কালো কাপড়ে তৈরি অনশনস্থলের প্যান্ডেলে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড তুলতে দেখা যায়। এতে লেখা ছিল, ‘মানুষ পুড়িয়ে গদি নিবি এ আশা করিস না’, ‘রবীন্দ্র নজরুলের বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নেই’, ‘মনুষ্যত্বের অবমাননা এ বাংলা সইবে না’। বিকালে অনশনে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দেশে সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষ কোথাও আজ নিরাপদ নয়। ককটেল, পেট্রোলবোমায় সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ’৭১-এর পর আমরা একটা নতুন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি। সহিংসতা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ যুদ্ধ। আমরা জানি এ যুদ্ধে আমরাই জয়ী হব। অনশনে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সৈয়দ হাসান ইমাম, বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, কবি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হারুন হাবীব, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ঝুনা চৌধুরী, মাসুম আজিজ, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ ও সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, নাদের চৌধুরী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, হারুণ হাবিব, মাসুম আজিজ প্রমুখ। পহেলা বৈশাখের মধ্যেই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান ॥ অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের পর প্রজন্মযোদ্ধা রাজীবসহ আরও কয়েকজন ...। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সর্বশেষ শিকার অভিজিৎ রায়। এরপর কে? সে যেই হোক, এতে ভয়ের কিছু নেই। কোন অবস্থাতেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত নয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে দেশবিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করতেই হবে। মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ; হত্যার মাধ্যমে কণ্ঠরোধ করা যাবে না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, বিজ্ঞানমনস্ক ও দেশপ্রেমিক মানুষের সংগ্রাম চলবেই। আগামী পহেলা বৈশাখের মধ্যেই সহিংসতা বন্ধ করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বানের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতকে বয়কট করতে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। শুক্রবার সকালে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় যাদুঘরের সামনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ ও মানববন্ধনে এসব কথা বলেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিগরা। মুক্তমনা লেখক প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের শাস্তি, পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা চালিয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতি বন্ধ করা এবং জামায়াত শিবিরসহ সকল উগ্র রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। এতে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ অজয় রায়। বক্তব্য রাখেন- ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ, জাসদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাংসদ নাজমুল হক প্রধান, তারেক আলী, অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান, সালেহ আহমেদ, গণতন্ত্রী পার্টিও প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম, আব্দুল ওয়াহেদ, আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, শহিদুল ইসলাম, জয়ন্তী রায়, প্রিয়া সাহা, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। মানববন্ধনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার। মানববন্ধন শেষে একটি শোকর‌্যালি অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা-ের ঘটনাস্থলে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে কর্মসূচীর সমাপ্তি হয়। মানববন্ধনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ। এ সময় আগামী পহেলা বৈশাখের মধ্যেই সহিংসতা বন্ধ করে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বানের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতকে বয়কট করতে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি অজয় রায়। তিনি বলেন, ‘ফারাবীকে ধরে কি হবে? সে একজন অভিজিৎ হত্যার একজন উস্কানিদাতা হতে পারে। সে তো ঘটনাস্থলে ছিলই না। আমি চাই আসল হত্যাকারীকে। হত্যার পর যে দুইজন মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেছে। এদের চিহ্নিত করতে এতক্ষণ লাগে না। পুলিশের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে মোটরগাড়ি নিয়ে তাদের অনুসরণ করা। প্রত্যক্ষদর্শীরাই বলেছে, পুলিশ তাদের পেছনে ধাওয়া করেনি। অর্থাৎ পুরো ঘটনার সময় পুলিশ ছিল নির্বিকার। সঙ্গত কারণেই খুনীরা ঘটনার পর পরই নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এই ঘটনা উদঘাটকে এফবিআই যুক্ত হয়েছে এরা হয়তো এত তাড়াতাড়ি ছাড়বে না, এরা শেষ দেখে যাবে। আমরাও সে আশায় রয়েছি। আমি মনে করি আন্তরিকভাবে কাজ করলে খুনীদের গ্রেফতার করা কঠিন কোন বিষয় নয়। এরা হয়ত দেশেই আছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অপরাধীদের এখনও ধরতে না পারায় তিনি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, এদের ধরতে এত সময় লাগার কথা নয়। যারা হত্যার হুমকি দিয়েছে, প্রকাশে ঘটনা ঘটিয়েছে এদের তথ্য নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। বুুয়েট শির্ক্ষীদের মানববন্ধন ॥ বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অভিজিৎ রায় হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। তারা দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি ওঠে। মানববন্ধনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- সাবেক শিক্ষক ও স্থপতি সামসুল ওয়ারেস, স্থপতি সুব্রত সরকার, প্রকৌশলী ইমরান হাবীব রুমন, তমাল, শম্পা বসু প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সবাইকে দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন, প্রতিবাদী সমাবেশ মিছিল ও প্রদীপ প্রজ্বলন কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার দিনব্যাপী বিশ্ববিদ্যায় ক্যাম্পসে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ছিল নানা আয়োজন। সকালে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করেছে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। সন্ধ্যায় নিয়মিত প্রদীপ প্রজ্বলন কর্মসূচী পালন করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
×