ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাহসিকার সোনালি নাম

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৯ মার্চ ২০১৫

সাহসিকার সোনালি নাম

রশিদ মামুন ॥ সময়টি সন্ত্রাসীদের উত্থানের। প্রতিদিনকার খবরগুলো ভয়ঙ্কর। মানুষ রাস্তায় বের হয় সাবধানী। উত্তরের জেলাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জামায়াতের নাশকতায় কখন প্রাণ যায়, কি হয় নিত্যক্ষণের শঙ্কা সকলকে তাড়া করছে। এর মধ্যেই একটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। রাজশাহীর এক সাধারণ নারী ঝর্ণা বেগম ২০১৩ সালের এপ্রিলে শিবির কর্মীদের হাত থেকে আর্মড পুলিশের উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলমকে বাঁচিয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। একজন সাধারণ নারীর সাহসিকতা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। এরপর সাধারণ মানুষ অনেকবার নাশকতাকারীদের রুখে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে যায়। কিন্তু হালে আমরা ঝর্ণা বেগমের কাছেই শিখেছিলাম কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় কীভাবে রুখে দিতে হয়। এখানে শেষ নয় সাহসী নারীর গল্প। ঝর্ণা পথ দেখান সেই পথে হাঁটেন ফাহিমা খাতুন। গেল ১১ ফেব্রুয়ারির আরেকটি ঘটনা যদিও খুব একটা প্রচার পায়নি তারপরও নাড়া দেয় বিবেকে। জাগিয়ে তোলে মানবতাকে। ঘটানাটি সেই রাজশাহীরই। জেলার গোদাগাড়ীতে দুই শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে প্রাণ দিলেন ফাহিমা। ঘটনাটি বড় কষ্টের বড় বেদনার। কিন্তু সাহসিকতার দিক দিয়ে বিচার করলে এই নারীকে স্যালুট না করে কি পারা যায় না। সাহসিকতা আর যোগ্যতার দিক দিয়ে সমাজে নারী পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে শিখেছে বহুকাল। প্রাচীনকাল কিংবা এখনও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলোতে নারীর প্রাধান্য রয়েছে। যদিও আধুনিকতার কোন কোন উদাহরণ নারীকে অবজ্ঞার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এসব সাহসী নারীদের অনুপ্রাণীত করার মতো উদাহরণ দেখে নারীই এগিয়ে আসবেন রচনা করবেন নতুন গল্প। দেশের যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদান কোন অংশে কম ছিল না। এখনও দেশের জন্য যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে-সাফল্যে নারীরা তাদের দক্ষতা যোগ্যতার প্রমাণ রেখে যাচ্ছেন। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাংলার বীর নারী প্রীতিলতা-ইলামিত্রসহ বহু নারী দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। তাদের নাম ইতিহাসে সোনার অক্ষরে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার রণাঙ্গনে যেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন-আজও সেই নারীদের বিজয়ের ইতিহাস হিমালয়ের মতো বড় হচ্ছে। বাংলার নারীরা হিমালয়ও জয় করেছেন। একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ এ্যাওয়ার্ড (আইডব্লিউওসি) বা ‘আন্তর্জাতিক সাহসী নারীর পুরস্কার’ পেলেন। নাদিয়ার এই পুরস্কার তার একার নয় এদেশের সাহসী প্রত্যেকটি নারীর অনুপ্রেরণা। মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় খবর সংগ্রহ করতে গেলে ২০১৩ এর এপ্রিলে নারী হয়ে কেন তিনি সাংবাদিকতা করছেন এজন্য ঢাকার রাস্তায় সংগঠনটির উগ্রপন্থী কর্মীদের হামলার স্বীকার হন নাদিয়া। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তোলে। বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদীদের নারীর প্রতি এ অত্যাচারে প্রতিবাদ করেন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও লেখকরা। কিন্তু দেশে তিনি খুব সহযোগিতা পাননি। ওই ঘটনার পরও নাদিয়ার মনোবল হারিয়ে যায়নি। কুচক্রে নিজের চাকরিটিও হারান নাদিয়া। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে খবরের শিরোনাম হয়ে যাওয়া নাদিয়ার দায় নিতে চায়নি তার প্রতিষ্ঠান। তাই বলে তো দমে যাননি থেমে যাননি নাদিয়া। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশে একজনও ছত্রীসেনা (প্যারা টুপার) ছিলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পুরুষ ছত্রীসেনার পাশাপাশি নারী ছত্রীসেনা তৈরি হয়েছেন। তারা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তবে প্যারা টুপারের আরও কিছু প্রশিক্ষণ রয়েছেÑ ওইসব প্রশিক্ষণের ওপর কাজ চলছে। অল্পদিনের মধ্যে প্যারা টুপারদের প্রশিক্ষণে পাঠানো হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বয়স অনুযায়ী সামরিক প্রশিক্ষণের দিক থেকে অনেক অগ্রগতি সাধন হয়েছে। এত দ্রুত অগ্রগতি খোদ আমেরিকার সেনাবাহিনীর ইতিহাসের হয়নি। আমেরিকার সেনাবাহিনীতে ১৯৭৬ সালে মহিলা প্যারা টুপার যুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নারী ছত্রীসেনা (প্যারা টুপার) হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন দুজন নারী। এদের দ্বিতীয় জন মেজর নুসরাত নূর আল চৌধুরী। সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসের পানিছড়া প্রশিক্ষণ মাঠে তিনি সফলভাবে আকাশ থেকে অবতরণ করেন। মেজর নুসরাত যখন আকাশ থেকে জাম্প করছিলেন তখন বিমানবাহিনীর এএন-৩২ নামের বিমানের অভ্যন্তরে থাকা অন্যদের চোখে মুখে ছিল উত্তেজনা। জাম্পটা সফল হলে আনন্দের অন্ত ছিল না। নুসরাত নূরের সেই সাফল্যে যেন হেসে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ। এ ঘটনাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে দ্বিতীয় নারী ছত্রীসেনার জন্ম নিল। এর আগে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসের কাছাকাছি পানিছড়া এলাকায় বিমানবাহিনীর একটি বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে সফলভাবে মাটিতে অবতরণের মধ্য দিয়ে এই সম্মান অর্জন করলেন। এই দলের চল্লিশ জনেরও বেশি সদস্যের সবাই পুরুষ, শুধু একজন ছাড়া। আর তিনিই জান্নাতুল ফেরদৌস। জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছে জানিয়েছিলেন এক হাজার ফুট উঁচু থেকে এই অবতরণের ঠিকভাবেই করতে পেরে তিনি তার রোমঞ্চিত। হাজার ফুট ওপর উচ্চতা থেকে কয়েক মিনিটে নিচে নেমে আসাই ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বাস্তবায়ন করেছেন। হাস্যোজ্জ্বল এই ছত্রীসেনা ওই সময় অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন ‘মনে হচ্ছে আরেকবার জাম্প দেই।’ সাহসী নারীদের গল্পের শেষ এখানেই শেষ নয়। এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে, যা নারী তো বটেই সমাজকে অনুপ্রাণিত করবে। শুধু দেশে নয় বিদেশেও নারীরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে দেশের ২১৭ নারী কাজ করছেন, যা সারাবিশ্বে প্রথম স্থানে তুলে ধরেছে বাংলাদেশকে। ট্রেন চালানো থেকে প্লেন চালানো কিংবা মাইন অপসারণ বা ভয়ঙ্কর কোন অপরাধীকে তুড়ি মেরে ধরে ফেলাতে এখন আর নারী পুরুষের তফাত নেই। রাজবাড়ীর সেই ইয়াদ আলী সর্বহারা পার্টির নেতা। চোখের পলকে খুন করেন লুটে নেয় মানুষের সম্পদ। পুলিশের অস্ত্র পর্যন্ত কেড়েও নিয়েছে। ভয়ঙ্কর এই অপরাধীর ভয়ে যখন কাঁপে এলাকার পর এলাকা। দিনের পর দিন যে ছিল প্রতিরোধহীন সেই ইয়াদ আলীকে ধরে কারাগারে পুরে দিয়েছেন রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার তাফতুন নাসরিন। ইয়াদ আলীর মতো অপরাধীরা এখন তাফতুনের ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠেন। এক তাফতুনে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে সাহসী নারীর গল্পর ইতি নয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্ট ফরিদা আক্তার পেট্রোলবোমাসহ দুই দুর্বৃত্তকে ধরে ফেলন। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরেও শান্তিরক্ষী মিশনে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন পুলিশের নারী সদস্যরা। পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারী-পুরুষে পার্থক্য খুঁজে পান না তাফতুন নাসরিন। এসব প্রতিদিনের কাজর অংশ বিশেষ। এমন সাহসিকতার গল্প পুলিশ কর্মকর্তাদের জীবনে অনেক আছে। জানতে চেয়েছিলাম নারী হিসেবে দায়িত্ব পালনে কোন সমস্যা বোধ করেন কিনা? হেসে জানালেন সমস্যা তো থাকবেই কিন্তু তিনি নারী এটা কোন সমস্যা নয়। জানালেন পতিতালয়ের কথা, বললেন অফিসারদের বলে দেয়া আছে সেখানে যেন কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে জোর করে কেউ যৌন সম্পর্কে বাধ্য না করতে পারেন তা দেখার জন্য। তিনি নিজেও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার দরজা নির্যাতিতদের জন্য সর্বক্ষণ খোলা, জেলার সকলকে বলা আছে যে কোন প্রয়োজনে যে কোন সময় ফোন করতে। দাবি করলেন আগের চেয়ে রাজবাড়ীর অপরাধ প্রবণতা কমেছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সবচেয়ে কম সময় নেয়া হচ্ছে। সেই সাহসী নারী ঝর্ণা বেগম এখন এই শহরেই কাজ করেন। এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২০১৩ সালে তিনি এমএলএসএস পদে যোগ দিয়েছেন। মেয়েটাকে স্কুলে দিয়েছেন। ঢাকার দক্ষিণগাঁয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। জানতে চেয়েছিলাম সমাজের অন্যান্য নারীর প্রতি তার আহ্বানের কথা। জানালেন যে কোন মানুষের বিপদ দেখলেই এগিয়ে যাব। নারী এখন আর পিছিয়ে নেই এটা নারীকেই বুঝতে হবে। সব সময় সামনের দিকে তাকাতে হবে। সমাজের দিকে তাকালে আমরা এগুতে পারব না। এজন্য সমাজের অনগ্রসর নারীর পাশেও অন্য নারীদের দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন ঝর্ণা।
×