ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতার অভয়ে হাসিনার আশ্বস্ত হওয়া কঠিন

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১০ মার্চ ২০১৫

মমতার অভয়ে হাসিনার আশ্বস্ত হওয়া কঠিন

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবেছিলেন তিনি বাংলার জুলিয়াস সিজার হবেন। সিজার তুরস্কের রাজা দ্বিতীয় ফেরানিসিসকে জেল্লার যুদ্ধে পরাজিত করে রোমের সিনেটকে উচ্ছ্বাসভরে বার্তা দিয়েছিলেন ‘ভিনি ভিডি ভিসি’ অর্থাৎ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। তেমনি আমাদের তৃণমূল নেত্রীও ভেবেছিলেন ঢাকায় পা রেখেই জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান দিয়ে আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও অংশুমান রায়ের সুরে গাওয়া গান ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ’ গানটির কলি আউড়ে বাংলাদেশের মন জয় করে নেবেন। এই ধারণা মাথায় নিয়েই তিনি তাঁর সঙ্গে শিল্পী, চিত্রতারকা, কবি, গাইয়ে ও বাজিয়েদের নিয়ে ঢাকায় যান। যাদের দিয়ে তিনি গান গাইয়ে, আবৃত্তি করিয়ে ও নাটকের ডায়ালগ বলিয়ে বাজিমাত করার চেষ্টা করেন। এই লক্ষ্যে কিছুটা সফল হলেও আবেগপ্রবণ বাঙালীদের মনে তাঁর সম্বন্ধে যে আশঙ্কা ও সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, সেটা কতটা দূর হয়েছে তা বলার এখনও সময় আসেনি। বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিকদের সঙ্গে চুটিয়ে বৈঠকী আড্ডা দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের মন জয় করার সাধ্যাতীত প্রচেষ্টা করে শেষমেশ কিছু লোকের মনে ঢেউ তুললেও তিনি তাঁর লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ শুধু সংস্কৃতি দিয়ে যে বাংলাদেশের মন ভিজবে না সেই বার্তা তিনি তাঁর সফরকালেই পেয়ে যান। বাংলাদেশের মানুষের আশা ছিল তিস্তার জলের সুষম বণ্টন এবং বাংলাদেশের জামায়াতপন্থী উগ্র জঙ্গীদের পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই দেয়া আর সেখানে তাদের ঘাঁটি গাড়তে দিয়ে বাংলাদেশে ধ্বংসাত্মক এবং সব ধরনের নারকীয় কা-কারখানা করার ছককে বানচাল করতে তিনি শেখ হাসিনা সরকারকে আশ্বস্ত করবেন। পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শত্রুসুলভ কর্মকা-কে তিনি বরদাশত করবেন না- এমন আশ্বাসবাণী তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল। আর তৃণমূল দলের নেতাদের বাংলাদেশে জামায়াতীদের অর্থ দিয়ে পুষ্ট করার ষড়যন্ত্রের কাজগুলোকে বন্ধ করার আশ্বাস দেবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের মৌলবাদী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’-এর অঙ্গীকারও তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঢাকা সফরের সময় ঘোষণা করবেন। সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গীদের ব্যাপারে তাঁর সরকারের অবস্থানও খোলসা করবেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা সফরে যান ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের স্থবিরতা দূর করতে নয়, নিজের ক্ষুদ্রতর স্বার্থ চরিতার্থ করতে। দু’দেশের মধ্যে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তিনি ঢাকা সফর করেননি। মহান একুশের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার ছুতো করে ঢাকায় গেলেন এমন এক সময়, যখন আবেগপ্রবণ বাঙালীদের ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিলে তারা অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাদের স্বভাবজাত আতিথেয়তার উচ্ছ্বাস ঘটে। মমতা সেই কাজটি সফরের সময়ে খুব সুচারুরূপেই করেছেন। তাঁর ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য ছিল ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে তিনি বাংলাদেশে যে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিলেন, তা যে কোন মূল্যে পুনরুদ্ধার করা। এই কারণের জন্যই তাঁর ও হাসিনা দিদির মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব ও আস্থাহীনতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল তা পুরোপুরি দূর করতে না পারলেও অন্তত তাকে কমিয়ে আনা তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল। তিস্তা চুক্তির খসড়াতে বাধা দিয়ে মমতা তাঁর হাসিনা দিদির রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে যেভাবে তলানিতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন এবং সে দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের রাজনৈতিক উত্থানে যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ভুলে যাওয়া খুবই কঠিন। কারণ তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁর ‘ছোটবোন’ মমতা তিস্তা চুক্তিতে বাগড়া দিয়ে তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবেন এবং দু’দেশের সম্পর্কে একটা পাঁচিল হয়ে উঠবেন। পরবর্তীকালে মমতা ও তাঁর পারিষদবর্গ তিস্তা চুক্তির বিরোধিতার সপক্ষে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্যও রেখেছিলেন- ‘পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য রাজ্য বা দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা করে দেয়া আমার দায়িত্ব নয়। সেটা মনমোহন সিংয়ের দায় হলেও হতে পারে।’ এই কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বুকে শেলের মতো বিঁধেছিল। ফলে এবার শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় মমতা দুই বাংলার গভীর সম্পার্কের কথা জাহির করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মন জয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। কারণ মমতা যখন বাংলাদেশকে ভারতে (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে) বেশি করে ইলিশ রফতানি করার আর্জি জানান, যাতে এপারে বাঙালীর পাতে বেশি করে ইলিশ পড়ে। তখন শেখ হাসিনা তাঁর অসহায়তার কথা ব্যক্ত করেন- ‘তিস্তায় পানি নেই, ইলিশ যাবে কী করে?’ মমতার চটজলদি জবাব, ‘ইলিশ তো আসে পদ্মা-মেঘনা থেকে, তিস্তা থেকে নয়।’ শেখ হাসিনার তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল- ‘পানি না পেলে ইলিশ যাবে কেমন করে?’ দুই নেত্রীর এই লঘু চাপান উতোর থেকে পরিষ্কার- তিস্তার জলের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রচুর দরকষাকষি হবে। আর এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হলে শেখ হাসিনার পক্ষে শুধু ইলিশ মাছ রফতানি করাই নয়, ভারতকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট সুবিধা দেয়াও অসম্ভব হবে। সাক্ষাতের সময় শেখ হাসিনাকে মমতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিস্তা নিয়ে টেনশন না করতে। তাঁর কথায়, ‘তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে আমি সবরকমের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করব। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলব। তিস্তা নিয়ে আপনাদের উদ্বেগের কোন কারণ নেই।’ এসব কথা বলে তিনি যতই হাসিনাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, মমতার কথা তিনি আন্তরিকভাবে কতটা বিশ্বাস করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। মমতা নিজেকে হাসিনা দিদির ছোটবোন বলে যতই দাবি করুন না কেন, ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তিতে শেষ মুহূর্তে ‘ভেটো’ দেয়ার নেতিবাচক ভূমিকা ও তাঁর মর্মান্তিক সব বক্তব্য শেখ হাসিনা ভুলে যাবেন কেমন করে? অপরদিকে মমতার সেই আচরণ ওই সময় ঝিমিয়ে থাকা খালেদা জিয়া ও মুসলিম মৌলবাদী শক্তির কাছে জীয়নকাঠি হিসেবে কাজ করেছিল। মমতা সত্যিই যদি তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হতেন, তাহলে তিনি ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারতেন। হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাঁর দম্ভোক্তি, ‘তিস্তা নিয়ে আলোচনা এতদিন বন্ধ ছিল। ঢাকায় এসে সেই দরজাটা আমি খুলে দিলাম।’ যা তাঁর মুখে একেবারেই বেমানান। তাঁর মহানুভবতা জাহির করার কোন প্রয়োজন ছিল না। দুই নেত্রীর আলাপচারিতা থেকে পরিষ্কার, তিস্তা চুক্তি বাতিলের জন্য হাসিনার ক্ষতটা এখনও শুকায়নি। সেই ক্ষত এখনও তাঁকে যন্ত্রণাপীড়িত করে। মমতাকে দলের প্রতীক একটি রৌপ্য নৌকা উপহার দিতে গিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘নদীতে যত বেশি জল আসবে তত সুন্দর বহমান হবে এই নৌকা।’ অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশের সুসম্পর্কের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তিস্তার জলের সুষম বণ্টনের মধ্যে। আগামী দিনে তিস্তা নিয়ে ভারত (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গ) ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা মাথায় রেখেই মমতা সফরকালে নদীর জল ভাগাভাগি নিয়ে গোল গোল কথা বলেন এবং এই বলে জ্ঞানও প্রদান করেন যে, ‘আমি আপনাদের মনের কথা বুঝি। তাও বলছি, সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা কোনদিন ভাগ হয় না। দুই দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখেই চুক্তি হবে। তিস্তার জল নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। তিস্তা দুই বাংলার।’ কিন্তু কিভাবে দু’দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে চুক্তি হবে সে সম্পর্কে তিনি একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। চুক্তি সম্পাদনে তিনি যেহেতু জট পাকিয়েছিলেন, তা খোলার দায়িত্বও তাঁর ওপরেই বেশি করে বর্তায়। কিন্তু সম্ভাব্য সমাধান সূত্র নিয়ে তিনি আজ অবধি কারোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেননি। যেসব নদী বিশেষজ্ঞ তাঁর আস্থাভাজন তাঁদের সঙ্গেও নয়। ফলে শেখ হাসিনা মমতার আশ্বাসবাণীতে কতটা মজবেন তা নিয়ে ঢাকায় অনেকের মনেই সংশয় আছে। কারণ শেষ মুহূর্তে মমতা ২০১১ সালের মতো যে কী খেলা খেলেন, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনাও সন্দিহান। মমতার ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির আশু সমাধান নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহের শেষ ছিল না। একই সঙ্গে তারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে তাঁর রাজ্যে বাংলাদেশের জঙ্গী জামায়াতীদের বাড়বাড়ন্ত এবং তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে তাঁর পুলিশ প্রশাসন ও শাসক দলের মদদের প্রশ্নে তাঁর সরকারের অবস্থান জানতে আগ্রহী ছিল। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের হাজতে পুরে বা ভারতের হাতে তুলে দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপ তিনি কোনমতেই চালাতে দেবেন না। বাংলাদেশের মানুষ একইভাবে আশা করেছিল, মমতাও তাঁর রাজ্যে তাঁদের দেশবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমনে ব্রতী হবেন। তাদের আরও আশা ছিল, মমতা একইভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবেন, পশ্চিমবাংলার মাটিতে বাংলাদেশবিরোধী শক্তিকে বিশেষ করে যারা তাঁর হাসিনা দিদিকে হত্যা করে ধর্মনিরপেক্ষ জোট সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ক্ষমতাসীন হতে চায়, তিনি সেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু মমতা তা করলেন না, যার ফলে সে দেশের মানুষের মনে তাঁর সম্বন্ধে সন্দেহের বীজ বপন হয়েছে এবং তা ক্রমশই ডালপালা মেলছে। ঢাকায় তো প্রশ্ন উঠেছে, মমতা সত্যিই কি শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের হিতাকাক্সক্ষী নাকি মৌলবাদীদের সমর্থক! তিনি তিস্তা চুক্তি, ইলিশ রফতানি, কলকাতায় বাংলাদেশ গেটওয়ে স্থাপন, বঙ্গবন্ধু ভবন নির্মাণ এবং দুই বাংলার চলচ্চিত্র আদান-প্রদান নিয়ে বহু কথা বলেছেন। দু’দেশের সাহিত্য-সংস্কতি নিয়েও তিনি বাংলাদেশের মানুষকে আবেগাপ্লুত করেছেন। কিন্তু নিজের দেশে মুসলিম ভোটব্যাংক দলের পক্ষে অটুট রাখার স্বার্থে তিনি জামায়াত সম্বন্ধে এক রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করেন। তাঁর দলের রাজ্যসভা সদস্য আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়াতীদের অর্থপুষ্ট হওয়ার অভিযোগ সম্বন্ধেও তিনি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন। যেসব জামায়াত জঙ্গী পশ্চিমবঙ্গের কিছু মাদ্রাসা, মসজিদ ও জনবহুল শহরে লুকিয়ে থেকে হাতবোমা, গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চার তৈরি করে তা চোরাপথে (সেফ করিডরের মাধ্যমে) বাংলাদেশে পাচার করছিল ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলানোর লক্ষ্যে। সে সম্বন্ধে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী হয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন কেমন করে? সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশজুড়ে খালেদা জিয়া ও মৌলবাদীদের ডাকা হরতাল সফল করতে যে ধরনের সহিংসতার পথ ধরা হয়েছে এবং মুড়ি-মুড়কির বোমা ও মলোটভ ককটেল ব্যবহার করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, এসব বিস্ফোরকের যোগান আসছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সেজন্য তাদের আশা ছিল, মমতা তাঁর সফরের সময় নিজের দলের এবং রাজ্য সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করবেন। কিন্তু তিনি তা না করে একেবারে চুপ থেকেছেন। আমার বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছেন, মমতা কি জামায়াতীদের খপ্পরে পড়েছেন? ভোট রাজনীতির কারণে কি তিনি তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে সাহস পান না? মমতা ঢাকায় গিয়ে এক চরম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। বলেছেন, আগেরবার অর্থাৎ ২০১১ সালে তিনি আসতে চেয়েও আসতে পারেননি কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি অত্রি ক্ষুদ্র লোক মাটির মানুষ। ক্ষমতা আমার সীমিত।’ আসলে তিনি মনমোহনের সঙ্গে ঢাকায় না যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন। এক অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে তিনি যে বেশি শক্তি রাখেন তা প্রমাণ করতেই তাঁর মনমোহনের সফরসঙ্গী না হওয়ার এই হঠকারী পদক্ষেপ। তিনি প্রমাণ করতে চাইছিলেন, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা, অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের তিনি সমগোত্রীয় নন। রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিজেকে উচ্চমার্গের বলে মনে করেন। আর সে কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ তিনি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, যার উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে নেই। তিস্তা চুক্তির খসড়ার বিরোধিতা করলেও মনমোহন সিং তাঁকে সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকা যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু মমতা সেই অনুরোধেও কর্ণপাত করেননি। মমতার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো পড়শী দেশ সম্বন্ধে ভারতের বিদেশনীতিতে তাঁর মত ফলানোর চেষ্টা সম্বন্ধে শেখ হাসিনা বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল। মমতা যে তিস্তা চুক্তিকে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, সেটাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। মনমোহন সিংয়ের মিলিজুলি সরকারকে তিনি যেভাবে পদে পদে হেনস্তা করে ইউপিএ ২ সরকারের মুখ পুড়িয়েছিলেন সেটা নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে করতে পারবেন না বলেই বিজেপির চাপে এবার তিনি ঢাকা যেতে বাধ্য হন এবং শেখ হাসিনাকে চুক্তিসহায়ক সব কথাবার্তা বলে মন ভোলানোর চেষ্টা করেন। মমতা তাঁর ঢাকা সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যে বার্তা দিলেন, তা হলো- ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী দেশ সম্বন্ধে ভারত সরকারের নীতিনির্ধারণে তাঁর বক্তব্য দিল্লীকে মাথায় রাখতে হবে। না হলে তিনি প্রতিবেশী দেশের সম্বন্ধে এমন সব বাগড়া দেয়ার মতো কাজ করবেন যে, দিল্লী তার সমাধানে কোন কূলকিনারা করতে পারবে না। স্থলসীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল সমস্যা নিয়ে তিনি ঢাকায় গিয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘ছিটমহলের সমস্যা আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি এবং সমাধান করে এসেছি।’ প্রশ্ন উঠেছে, এই উদ্যোগ ও পদক্ষেপগুলো তিনি মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে নিলেন না কেন? তাহলে তো মনমোহন ও শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো না এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও উন্নত ও সুদৃঢ় হতো। দিল্লীর লুক-ইস্ট পলিসিকে আরও গতিশীল করতে এবং উপমহাদেশে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক বিরাট অবদান রেখে তা এলাকার চালচ্চিত্রই পাল্টে দিত। বলতে বাধা নেই, চার বছর আগে মমতা তা ইচ্ছাকৃতভাবেই হতে দেননি। কিন্তু এবার নিজের ছবি উজ্জ্বল করতে এবং নরেন্দ্র মোদিকে নিজের ‘ওজন’ বোঝানোর তাগিদেই তাঁর এই ঢাকা পরিক্রমা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির তাগিদে নয়। লেখক : সম্পাদক, স্টেটসম্যান
×