ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাসান আলী নিজে জীবন চক্রবর্তী ও কামিনী ঘোষকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ মার্চ ২০১৫

হাসান আলী নিজে জীবন চক্রবর্তী ও কামিনী ঘোষকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার হাসান আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ২০তম সাক্ষী গৌরী রাণী চক্রবর্তী জবানবন্দীতে বলেছেন, আসামি হাসান আলী শুধু নিজ হাতে মানুষ হত্যা করেনি তার নির্দেশে এলাকায় লুটপাট, গরু-বাছুর নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আসামি নিজ হাতে গুলি করে জীবন চক্রবর্তী ও কামিনী ঘোষকে হত্যা করেছে। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করেন। পরবর্তী সাক্ষীর জন্য আজ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আরেকটি মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ও মোঃ আফসার হোসেন চুটুর বিরুদ্ধে প্রসিকউশনের ৮ম সাক্ষী মহসীন আলীকে জেরা করেছে আসামি পক্ষ। পরবর্তী সাক্ষীর জন্য বৃহস্পতিবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ আদেশগুলো প্রদান করেছেন। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মহেশখালীর গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ রশিদ মিয়ার পক্ষে তিনটি আবেদন করা হয়েছে। এতে তার ডিভিশন ও কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আসার সময় অ্যাম্বুলেন্স ব্যাবহার করার জন্য। আরেকটি আবেদনে প্রসিকিউশনের কাছে যে কাগজপত্র আছে তা আসামি পক্ষকে দেয়ার জন্য। উল্লেখ্য মহেশখালীর তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পর সালামতউল্লাহ খান ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়া এ দুইজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মৌলভী জাকারিয়া সিকদারকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার হাসান আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ২০তম সাক্ষী গৌরী রাণী চক্রবর্তী জবানবন্দী প্রদান করেছেন। আজ ২১তম সাক্ষীর জবানবন্দী প্রদান করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সাক্ষীকে জবানবন্দীতে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম গৌরী রানী চক্রবর্তী । আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর। আমার ঠিকানা গ্রামÑ চিকনী, থানাÑ তাড়াইল, জেলাÑ কিশোরগঞ্জ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ৩৫ বছর। সে সময় আমার চার ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা হিন্দুরা রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের কারণে সব সময় আতঙ্কিত থাকতাম। ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর বাংলা ২১ আশ্বিন শুক্রবার দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার দুই ছেলে বাঁধন চক্রবর্তী, চন্দন চক্রবর্তী, ভাসুর সুকুমার চক্রবর্তীর ছেলে সাধন চক্রবর্তী এবং দেবর জীবন চক্রবর্তীর ছেলে নারায়ণ চক্রবর্তী আমাদের বাড়ির কাছে পুরুরাবাজারে যায়। তারা বাজারে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ৫ রাজাকার আমাদের বাড়িতে আসে। রাজাকাররা এসে আমার দেবর জীবন চক্রবর্তীকে খোঁজ করে। আমরা তাদের কথায় কোন জবাব না দিলে একজন রাজাকার রাইফেলের বাট দিয়ে আমার ডান গালে আঘাত করলে গাল থেকে রক্ত ঝরে। তারপর রাজাকাররা জীবন চক্রবর্তীকে আটক করে হাত-পা বেঁধে ফেলে। সাক্ষী আরও বলেন, আমি ও জীবন চক্রবর্তীর স্ত্রী মিলন রানী কান্নাকাটি করে রাজাকারদের জীবন চক্রবর্তীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। তখন রাজাকাররা বলে টাকা দিলে ছেড়ে দেব। তখন আমরা বাড়িতে থাকা তিনশত টাকা রাজাকাররদের দেই। রাজাকাররা মিলন রাণীর গয়নাগাটি নিয়ে নেয়। ওই টাকা ও গয়নাগাটি নিয়ে রাজাকররা বলে তারা ওই মহূর্তে জীবন চক্রবর্তীকে ছাড়তে পারবে না। কারণ রাজাকার কমান্ডার হাসান আলী দারোগা কামিনী ঘোষের বাড়িতে অবস্থান করছে। তার অনুমতি ব্যতীত ছাড়া যাবে না। ওই সময় রাজাকার আসকর আলী রাজাকার সোলজারকে বাড়িতে থাকা পাঁচটি গরু থানায় পৌঁছে দেয়ার জন্য বলে। আসকর আলী আরও বলে, আসামি হাসান আলী দারোগা ওই গরুগুলো থানায় পৌঁছে দিতে বলেছে। রাজাকাররা আমাদের পরনের কাপড়-চোপড় ব্যতীত বাড়ির সমস্ত মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। সাক্ষী বলেন, রাজাকাররা আমার দেবর জীবন ঠাকুরকে নিয়ে কমিনী ঘোষের বাড়িতে যায়। যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমরা দুটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। বাড়িতে থাকা অবস্থায় আমরা লোকমুখে শুনতে পাই, আমার দেবর জীবন চক্রবর্তী ও কামিনী ঘোষকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করেছে। সন্ধ্যার দিকে ছেলেরা বাড়িতে ফিরে এলে তাদেরকে আমরা ঘটনার কথা বলি এবং আমরা সবাই মিলে কামিনী ঘোষের বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা আমার দেবর জীবন চক্রবর্তী ও কামিনী ঘোষের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। সেখানে উপস্থিত কামিনী ঘোষের ছেলের স্ত্রী রেখা রাণী ও ওই বাড়ির সঞ্জু সরকার আমাদেরকে জানায়, বিকেল আনুমানিক চারটার দিকে আসামি হাসান আলী দারোগা নিজ হাতে ওই দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেছেন এবং তারা ওই ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছে। রেখা রাণী আরও জানায়, সে তার শ্বশুর কামিনী ঘোষের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও আসামি হাসান আলী দারোগা তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। সে আরও জানায়, রাজাকাররা যাওয়ার সময় হুমকী দিয়ে গেছে যে, লাশগুলো যেন পোড়ানো না হয়, মাটিচাপা দেয়া হয়। সাক্ষী বলেন, রেখা রানী আমাদের আরও জানায়, রাজাকাররা তাদের বাড়ি আক্রমণ করলে তাদের মধ্যে একজন নিজেকে হাসান আলী দারোগা রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দেয়। এবং কামিনী ঘোষকে আটক করার পর কয়েকজন রাজাকাররকে জীবন চক্রবর্তীকে ধরে আনার জন্য হুকুম দেয়। রোখা রাণী রাজাকারগণ কর্তৃক তাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, ঠাকুরের ছবি ভাংচুর, গরু-বাছুর নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে বর্ণনা করেন। তাদের সব ঘটনা শুনে জীবন চক্রবর্তীর লাশ আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি এবং মাটি চাপা দেই। দেশ স্বাধীন হলে আমরা জীবন চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধ শান্তি করি। একই দিন কামিনী ঘোষের লোকজনও তার শ্রাদ্ধ শান্তি করে।
×