ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবারের স্বাধীনতা পদক প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১১ মার্চ ২০১৫

এবারের স্বাধীনতা পদক প্রসঙ্গে

আমাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতার পদক। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকেরা স্বাধীনতার আদর্শকে যেমন ভূলুণ্ঠিত করেছেন, তেমনি করেছেন এই স্বাধীনতা পদকের মর্যাদাকেও। বিএনপির প্রত্যেকটি সরকার এই স্বাধীনতা পদকের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য যাদের সর্বোচ্চ অবদান আছে, তাদের জন্য এই পদক। কিন্তু বিএনপি সরকারের আমলে এমন এক পীরকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য যাকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলে যেতে হয়েছিল। জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়া- বিএনপির প্রত্যেকটি সরকার বেছে বেছে এমন সব ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পদক দিয়েছে, পাকিস্তানের জন্য আন্দোলনে যাদের অনেকেরই বড় ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ছিল না। এ জন্যই কয়েক বছর আগে যখন হাসিনা সরকার আমাকে স্বাধীনতা পদক দেয়ার প্রস্তাব দেন, আমি তা গ্রহণে প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, অযোগ্য এবং অনেক স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে এই পদক দেয়ায় এর মর্যাদা এতটা ক্ষুণœ হয়েছে যে, এটা গ্রহণের মধ্যে আর কোন গৌরব নেই। ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি, ড. মুহম্মদ ইউনূসের মতো লোক নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, এই প্রাইজটি তার মর্যাদা হারিয়েছে এবং আমার মতো একজন নগণ্য ব্যক্তিকেও এখন এই পুরস্কার দেওয়া হলে আমার উচিত হবে তা প্রত্যাখ্যান করা। বার্নার্ড শ’ নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যখন তাঁকে পুরস্কারটি দেয়া উচিত ছিল, তখন না দিয়ে অনেক যদু মধুকে পুরস্কারটি দেয়ার পর যখন শ’কে তা দিতে চাওয়া হয় তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কয়েক বছর আগে আমি অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক গ্রহণে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছি এবং পুরস্কারটি গ্রহণ করেছি। তার প্রথম কারণ, প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনাকে আমি অসম্মান করতে চাইনি এবং দ্বিতীয় কারণ, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীর চাপ অগ্রাহ্য করতে পারিনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে যোগ্য ও গুণী ব্যক্তিরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পদক পান এটা আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে এটাও দেখেছি, তাদের সিদ্ধান্তে কোথায় যেন একটা ভারসাম্যহীনতা থাকে। এটা আমলাদের দ্বারা নাম বাছাইয়ের ফল কিনা জানি না। তবে এবারে স্বাধীনতা পদকদানে একটা বড় রকমের ভারসাম্যহীনতা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখ এড়িয়ে গেছে। নইলে এমনটা তিনি ঘটতে দিতেন না বলেই আমার ধারণা। এ বছর অনেক যোগ্য ও গুণী ব্যক্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির অন্যতম নেতা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান প্রায় নবতিপর অধ্যাপক মুজাফফর আহমদকে স্বাধীনতার পদক দেয়া হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে জানাচ্ছি, তাতে এই বয়োবৃদ্ধ জননেতাকে সম্মান দেখানো হয়নি। বরং তাঁর সম্মান ক্ষুণœ করা হয়েছে। তবুও তিনি যে পদকটি গ্রহণে সম্মত হয়েছেন এটা তাঁর মহানুভবতা। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমবয়সী। দু’জনের মধ্যে তুমি তুমি সম্পর্ক ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সমপর্যায়ের রাজনৈতিক দলের নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধেরও একজন শীর্ষ নেতা। তাঁকে স্বাধীনতা পদক দিতে হলে বহু আগে দিতে হতো। বিএনপি প্রকৃত স্বাধীনতা যোদ্ধাদের এই পদক দেবে না তা জানা কথা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল না, তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত বীরদের যথাসময়ে সম্মানিত করতে পারেনি এটাও সত্য কথা। এখন বিলম্বে এই সম্মান জানাতে গিয়ে যাকে পদক দেয়া হবে তার বয়স এবং দেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান ও অবদানের কথা পুরস্কারদাতাদের স্মরণে রাখা উচিত ছিল। কিছু বয়োকনিষ্ঠ ব্যক্তি, তারা যতই গুণী হন, তাদের সঙ্গে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদকে এক কাতারে বাধা উচিত হয়নি। পাকিস্তান আমলের একটা উদাহরণ দিই। তখন সাহিত্যে আদমজী পুরস্কার দেয়ার রেওয়াজ ছিল। একবার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের একটি বইকে আদমজী পুরস্কার দেয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়। পরে সিদ্ধান্তটি বাতিল হয়ে যায়। কারণ, আবুল ফজল তার বইটিতে লিখেছিলেন, “ধর্ম কখনো সভ্যতার ভিত্তি হইতে পারে না।” কথাটা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কানে যায়। তিনি ব্যাপারটিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তখন তড়িঘড়ি আবার আবুল ফজলকে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু আইয়ুব খান তাতে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, যেসব কম বয়সী লেখকদের সেবার আদমজী পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাদের পাশে বর্ষীয়ান লেখক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। ফলে তার জন্য প্রেসিডেন্টের স্পেশাল পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। সে বছর একা আবুল ফজল প্রেসিডেন্সিয়াল পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স পান। পাকিস্তান আমলেও সরকারের মধ্যে যে বিবেচনাটি কাজ করেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে সে বিবেচনা কাজ করছে না দেখে দুঃখ বোধ করছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শীর্ষ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর বয়সী রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র অধ্যাপক মুজাফ্্ফর আহমদই এখন বেঁচে আছেন। তাঁর শরীরের ও স্বাস্থ্যের যা অবস্থা, যে কোন সময় তিনি চলে যেতে পারেন। তাঁকে বিলম্বিত সম্মান জানাতে হলেও সরকারের উচিত ছিল কোন বিশেষ ব্যবস্থা করার। তাঁর মর্যাদাকে হরেদরে মিশিয়ে ফেলে তাঁকে সম্মান জানানো হয় না। আরেকটি কথা, যারা দেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং নেশন বিল্ডার, তাঁদের স্থান সকল রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের উর্ধে। মহাত্মা গান্ধীকে ভারত ভূষণ বা পদ্মভূষণ কোন খেতাব বা পদকই দেয়া যায় না। তাঁদের নামে পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে বিএনপির আমলে স্বাধীনতার পদক দেয়া হয়েছে, তাও আবার তাঁর সরকারের অধীনস্থ এক সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে যুক্তভাবে। এর পেছনে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য এবং অজ্ঞতা দুই-ই কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যটি ছিল, জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে তুলে আনা এবং অজ্ঞতা ছিল জাতির পিতাকে কখনো সকলের জন্য প্রচলিত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বা খেতাবও দেওয়া হয় না এটা না জানা। গান্ধী, ওয়াশিংটন বা লেনিনকে এই রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়নি। এই ব্যাপারে বিএনপি সরকারের কার্যক্রমে ছিল অজ্ঞতা ও অসৎ উদ্দেশ্যের মিশ্রণ। আজকাল স্বাধীনতার পদক ও একুশের পদক দেওয়ার ব্যাপারে নাম বাছাইয়ের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই সুবিবেচনার অভাব লক্ষ্য করছি। দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে এই সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকগুলোকে উর্ধে রাখা দরকার। নইলে এগুলো তার সম্মান ও মর্যাদা হারাবে। রাজনৈতিক অনুগ্রহ হিসেবে যেন এই পদক ও পুরস্কারগুলোকে ব্যবহার করা না হয়। প্রসঙ্গক্রমে কথাটা তুলছি। দেশের অনেক সাংবাদিক, সম্পাদক একুশের ও স্বাধীনতার পদক পেয়েছেন। এক্ষেত্রেও একজন বর্ষীয়ান সম্পাদকের নাম অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের মতোই কেন দীর্ঘকাল ধরে বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে আছে তা আমি জানি না। এই নামটি হলো তোয়াব খান। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অসামান্য। মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি ও গণসংযোগ অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। এই নামটি কেন একুশে বা স্বাধীনতার পদক প্রদানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিবেচনায় আসে না তা আমার বোধগম্য নয়। [ল-ন, ১০ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৫]
×