ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিচ্ছিন্নতার নেটওয়ার্ক

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১১ মার্চ ২০১৫

বিচ্ছিন্নতার নেটওয়ার্ক

অদ্ভুত প্যারাডক্স! বিশ্বজোড়া বন্ধু অথচ ঘাতকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে এলো না কেউ। হায় বন্ধুত্ব! হায় ভার্চ্যুয়াল ইল্যুশন। ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মা-ের অলিগলিতে বন্ধুত্বের জয়গান গাওয়া হয়। অথচ চরম বিপর্যয়ের মুখে দেখা মেলে না একজন বন্ধুরও। আসলেই একি বন্ধুত্ব নাকি বিচ্ছিন্নতা? বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে যা জিইয়ে রাখা হয়। অভিজিতের মুখ থুবড়ে পড়া ফুটপাথের সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নই বার বার ঘুরেফিরে আসছিল। ঘটনার এক দিন পর ওখানে মৃতদেহ ছিল না। ছিল না হত্যার ছিটেফোঁটা নমুনাও। তবু বসন্তের শেষ বিকেলে নিউ ইস্কাটন থেকে টিএসসি পর্যন্ত হেঁটে এসে ওই ফুটপাথ স্পর্শ করতেই চারপাশে উদারবাদ, নয়া উদারবাদ, উত্তর আধুনিকতার নোংরা মাছি কিলবিলিয়ে ওঠে। অভিজিত ঘাড়ে মাথায় আঘাত নিয়ে পড়ে যাচ্ছেন, তলিয়ে যাচ্ছেনÑ চারপাশে মানুষ হাঁটছে। চৌকি বসিয়ে পুলিশ সন্ত্রাসী ধরার জন্য উৎকর্ণ। অথচ বাঁচার জন্য অভিজিতের প্রাণফাটা আর্তনাদ কানে পৌঁছচ্ছে না কারও। এই ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, বাংলা একাডেমিÑ দেশের সর্বোচ্চ সংস্কৃতিমনস্ক এলাকা বাঁচাতে পারেনি অভিজিতের মতো আলোকিত এক তরুণকে। শহরের মানুষ কিসে নিমজ্জিত? কোন্ দুঃস্বপ্নের ঘোরে? স্যামুয়েল বেকেটের মতো তারাও কি গডোর জন্য অপেক্ষা করছে? নিষ্ক্রিয়, নিরোদ্যম অপেক্ষা তাদের কোথায় পৌঁছে দিচ্ছে? বেকেটের ভøাদিমির আর এস্ত্রাগন জানে না তাদের প্রতীক্ষার পরিণতি। তাদের অনন্ত প্রতীক্ষা শেষ হয় না। মুক্তিদাতা কিংবা উদ্ধারকর্তা গডো আসেন না। তারা দু’জন বিচ্ছিন্ন। সময় থেকে, সমাজ থেকে, মানুষ থেকে। বিচ্ছিন্নতা কখনও মুক্তি দেয় না, বরং শৃঙ্খলকে আরও বেশি দৃঢ় করে। আর ওটাই বড় অস্ত্র বিশ্বজোড়া পুঁজি নেটওয়ার্কের। ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এককে অন্যের থেকে, যাতে সংগঠন দাঁড়াতে না পারে। সংগঠন মানেই সম্মিলিত শক্তি। আর সম্মিলিত শক্তি প্রতিবাদী হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে যায় শোষকের দুর্গ। এ জ্ঞান বড় টনটনে পুঁজিবাদী দুর্গ রক্ষকদের। প্রতিকার এবং প্রতিষেধক হিসেবে তাই এখনকার বিশ্বে তারা বিচ্ছিন্নতার ভাইরাস ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামের এ ভাইরাস মানুষকে যতটা সামাজিক করে, বিচ্ছিন্ন করে তার চেয়ে অনেক বেশি। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্বের তালিকা যত দীর্ঘ হয়েছে ততই শিথিল হয়েছে মানবিক বন্ধুত্বের আত্মিক সম্পর্কগুলো। বন্ধ ঘরের কোণায় বসে দেশ-বিদেশের অচেনা ‘বন্ধু’দের সঙ্গে মতামত শেয়ার, নিজের মন্তব্যে ‘লাইক’ পড়া, অন্যকে ‘লাইক’ দেয়ায় পারস্পরিক যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা একেবারেই বায়বীয়। পাড়ার লাইব্রেরিতে বই শেয়ার করা কিংবা বিতর্কের টেবিলে যুক্তির বাণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা অথবা কাঁচা হাতে নাটক লিখে পাড়ার ক্লাবে দুর্বল মঞ্চায়নের দুর্দান্ত আনন্দÑ এসবই মানবিক সম্পর্কের ভিত নির্মাণ করে। সামাজিক সম্পর্কের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। এ স্বাভাবিকতাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব। মানবিক বোধের সবটুকু জায়গা দখল করেছে আত্মকেন্দ্রিকতা। রক্তাক্ত দেহের আর্তচিৎকার তাই পৌঁছায় না পাশের মানুষের হৃদয়ে। ‘মেটামরফসিস’-এর গ্রেগর সামসার বুকফাটা কান্নাও পৌঁছেনি কারও কানে। মা বাবা বোন কারও কানে নয়। গ্রেগর ঘাতকের আঘাতে রক্তাক্ত হয়নি। কিন্তু রূপান্তরিত অতিকায় দেহ নিয়ে প্রতি মুহূর্তে একাকিত্ব আর বিচ্ছিন্নতার রক্তক্ষরণে ক্লিষ্ট হয়েছে। কাফকার ভূবন বিখ্যাত এ উপন্যাসিকাটি বাজারে আসার আগেই পুুঁজিবাদ বাজারে তার নিজের অবস্থান বদলিয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে সরে এসে একচেটিয়া পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। সেও এক মেটামরফসিস বা রূপান্তর। অল্প কয়েকটি ট্রান্সন্যাশনাল কর্পোরেশনের শাসনে বাঁধা পড়ে বিশ্বের সিংহভাগ উৎপাদন। তখন তার প্রয়োজন হয় বিশ্বের তাবত বাজারের বাণিজ্য বাধা তুলে দিয়ে একচেটিয়া পুঁজির কাছে পুরোপুরি উন্মুক্ত করার। বাজারের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার। এই রূপান্তরিত পুঁজি জন্ম দেয় এক নতুন শব্দ- গ্লোবালাইজেশন বা ‘বিশ্বায়ন’। উদার প্রতিযোগিতার প্রগতিশীল অভিমুখে পুঁজির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, একাচেটিয়া পুঁজির অবাধ স্রোতে দু’কূল ছাপিয়ে তা ভেসে যায়। ব্যক্তির ওপর পুঁজি চেপে বসে ‘মেটামরফসিস’-এর অতিকায় দানবের মতোই। ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি সম্ভবত পূর্ণতা পায় ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে। পৃথিবী আসে হাতের মুঠোয়। প্রচার-প্রচারণার বিভ্রম ছড়িয়ে এর স্বয়ম্ভু ইমেজ তৈরি করলেও মূলত এর নিয়ন্ত্রণ থাকে একচেটিয়া পুঁজির শক্তিশালীর হাতে। বাজার সম্প্রসারণ, বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র সন্ধান, পণ্যের প্রসার ও প্রচার ইত্যাদি কাজেই একে ব্যবহার করেন পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ক্ষমতাধররা। কিন্তু প্রচারের মোড়কটি পরানো হয় এমনভাবে যে, মনে হয় বিশ্বজোড়া মানব কল্যাণের জন্যই এ প্রযুক্তি নিবেদিতপ্রাণ। অথচ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয় শুধু এই ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির তিরিশটি কর্পোরেশনের বারোটিই ইন্টারনেট জগতের একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান। এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে এ বাজার, অন্য কারও প্রবেশ এখানে প্রায় অসম্ভব। এই ডিজিটাল সাম্রাজ্যের অধিপতিরা নিজেদের বাণিজ্য ও মুনাফাকে নিরুপদ্রব রাখে এমন সংস্কৃতিই ওয়েবে ছড়ায়। বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়া এর অন্যতম প্রজেক্ট। সেজন্যই সর্বগ্রাসী পুঁজির বিরুদ্ধে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ হঠাৎই আলোড়ন তোলে, কিন্তু আন্দোলনে পরিণত হতে পারে না। গ্রিসসহ আরও কয়েকটি দেশের বেকাররাও ফুঁসে উঠে কিছু সময় গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে থেকে দ্রুতই মিইয়ে যায়। আরব বসন্ত কিংবা আমাদের শাহবাগের তরুণরা ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনার জন্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আন্দোলন দানা বাঁধে না। মানুষ সংঘবদ্ধ হতে পারে না। কারণ তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বাস্তব জগতে যেমন, তেমনই ভার্চ্যুয়াল জগতে। ভাঙনের কাজ দু’দিকেই চলছে অবিরত। সেজন্যই রক্তাক্ত অভিজিতকে নিঃসঙ্গ পড়ে থাকতে হয় ফুটপাথে। কিন্তু মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। দলবদ্ধ প্রাণী। সে স্বাধীন, কিন্তু শৃঙ্খলও থাকতে হয় তার। আর পাঁচজনের সঙ্গে সম্পর্কের শৃঙ্খল ভীষণই জরুরী তার জন্য। প্রয়োজন দায়িত্বের শৃঙ্খল। বাধাহীন, দায়িত্বহীন স্বাধীনতার অন্য নাম উচ্ছৃঙ্খলা। বাধাহীন স্বাধীন, সার্বভৌমতা হতে পারে না। ব্যক্তির ইচ্ছার ওপরে প্রাধান্য পাবে সাধারণ ইচ্ছা। এই ইচ্ছার শৃঙ্খল ব্যক্তির উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। এ হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খল। একের প্রতি অন্যের দায়বদ্ধতার বোধ। এর অভাব হলে শিথিল হয় সামাজিক সম্পর্ক। বিছিন্ন হয় একের থেকে অন্যে। এসব কথা রুশো বলে গেছেন ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’-এ। এই বিছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয় উত্তরবাদীরা। আর সবাই জানেন উত্তরবাদ দাঁড়িয়ে আছে নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর, যার মূল দর্শনই হচ্ছে বিচ্ছিন্ন করা। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিকে। সংগঠন থেকে কর্মীকে। উত্তরবাদী তাত্ত্বিকদের অনেকে বিশ্বজুড়ে পুঁজির অবাধ প্রবাহ বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর পৃথিবী ও মানবজাতিকে প্রভাবিত করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, অর্থবাজারের বহুজাতিকতা ইত্যাদি দেখে তত্ত্ব দিয়েছেন যে, বিশেষ কোন রাষ্ট্রের প্রতি পুঁজির আনুগত্য দেখানোর আর প্রয়োজন নেই। জাতি-রাষ্ট্র গুরুত্ব হারাচ্ছে ইত্যাদি। রাষ্ট্রকে গুরুত্বহীন করার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ পৃথিবীজোড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাহীন মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামকে নাকচ করা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকেই জাতি-রাষ্ট্রের নিজস্ব আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রই যদি না থাকে তাহলে আন্দোলন-সংগ্রামেরও আর প্রয়োজন নেই। একদিকে রাষ্ট্রকে গুরুত্বহীন করার তত্ত্ব, অন্যদিকে রাষ্ট্রকে আশ্রয় করে সন্ত্রাস, দুর্নীতির অবাধ স্বাধীনতার পথ পাকাপোক্ত করা- এ দু’ধরনের তৎপরতার অন্তর্নিহিত বাণী সম্ভবত এরকমÑ রাষ্ট্র থাকবে, তবে তার নিয়ন্ত্রণ কখনও জনগণের হাতে আসবে না। রাষ্ট্র থাকবে, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেখান থেকে কোন চাপ থাকবে না। জনগণ বিশেষ করে গরিব ও দুর্বল মানুষ রাষ্ট্রের আনুকূল্যের বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের করুণাধন্য হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির আসল পরিবর্তনটা সমাজের নিচের তলার ক্ষমতা বিন্যাস থেকে প্রকট হয়ে উপর কাঠামোয় নানাভাবে এসে প্রকাশ পায়। এর সবচেয়ে স্পষ্ট যে চিত্রটি আমরা দেখতে পাই তাকে মোটাদাগে বলা যেতে পারে দুর্নীতির সংস্কৃতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্ত্রাসের সংস্কৃতি। যার সবশেষ বলি অভিজিত রায়।
×