ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সোনালী অনিশ্চয়তার খেলা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১২ মার্চ ২০১৫

সোনালী অনিশ্চয়তার খেলা

বেগম খালেদা জিয়ার ‘বেরহম’ হৃদয়ে এ কোন্ ‘দেশপ্রেম’? নাকি পলিট্রিক্স? দু’মাসের উপরে অবরোধবাসিনী দেশনেত্রী দেশের পনেরো লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর জীবনে শঙ্কা-দুর্ভোগ সৃষ্টি করে গত দেড় মাস ধরে হরতাল দিয়ে যাচ্ছেন। কোন বিরতি নেই শুক্র-শনিবার ছাড়া। তিনি কুটিল চক্রান্তে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মাদাহ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ব্যক্তিগত আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শতরান করার কৃতিত্ব অর্জন করলেন। রুবেল, মুশফিক, সাব্বির এমনকি সৌম্যও দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করেছেন প্রচণ্ড শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতায়। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দক্ষতার সঙ্গে বিজয় রথকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন আর এ বিজয়কে মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণকে উৎসর্গ করেছেন। এ বিজয়ে দেশ-বিদেশ ভেসে গেছে প্রশংসার বন্যায়। এমনকি ব্রিটিশ সংবাদপত্র, ক্রিকেটপ্রেমী জনগণ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দেশের জয়ে এতই উৎফুল্ল হয়েছেন যে, হরতাল ১২ ঘণ্টা তুলে দিয়েছেন। তবে প্রতিহিংসার চলমান দু’দফার ৫ দিন বা টানা ১২০ ঘণ্টার অযৌক্তিক হরতাল আবার চলবে। দেশের সাধারণ মানুষ, লাখ লাখ ভবিষ্যত নাগরিককে দুর্ভোগে ফেলতে তাঁর কোন ছাড় নেই, কারণ তিনি তো ‘দেশের নেত্রী’। কেবল কি এসএসসি? এ লেভেল এবং ও লেভেল পরীক্ষার্থীদের কতটা বিড়ম্বনা এবং আশঙ্কার মধ্যে দিনপাত করতে হচ্ছে, তার হিসাব দেশনেত্রীর কাছে বড় নয়। দেশবাসী কৃষক-শ্রমিক, দোকানি, ব্যবসায়ী, বাণিজ্য, পরিবহনে যে ক্ষতি তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না এ হরতালে। কারণ তাঁর আত্মীয়স্বজন, দলনেতাদের প্রতিষ্ঠান তো চলছেই, তারা তো গাড়ি চড়েই হরতাল করছেন। আহারে নেতৃত্ব! ক্রিকেট খেলার জয়ে এতটাই পুলকিতবোধ করলেন মাদাম যে হরতাল ১২ ঘণ্টা উঠিয়ে দিলেন। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাঁর দেয়া এবং জনগণ তো বটেই তাঁর নেতাকর্মীদেরও না মানা হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এই সময় ২০ দলীয় জোট ‘আনন্দ মিছিল’ করবে। কর্মীদের আনন্দ মিছিল করার জন্য হরতাল প্রত্যাহার করতে পারলেন, অথবা লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবনের এত বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পরীক্ষায় হরতাল বাদ দিতে পারলেন না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ করলে নলখাগড়ার প্রাণ যায়, এমনি তো ঘটছে মাসের পর মাস, তাপ-উত্তাপবিহীন ‘দেশনেত্রী’। কিন্তু কী এমন কারণ হলো আনন্দ-উল্লাসের জন্য ১২ ঘণ্টা হরতাল উঠিয়ে দিলেন? নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে এই হরতালে ছাড় দেয়ার ভেতর। আনন্দ মিছিল তো করবেন ভাল কথা, কিন্তু এই জনতার আনন্দে বাগড়া দেয়ার জন্য তো আবার বোমা, ককটেল ফাটাবেন না, কেড়ে নেবেন না মানুষের জীবন? আপনি তো ‘দেশনেত্রী’- জনসাধারণের নেত্রী নন! তবে খালেদা জিয়া আপনার যে মতলবই থাক না কেন, এ বিজয় জনগণের, দেশের, লাল-সবুজের পতাকার আত্মবিশ্বাসের। এখানে আত্মম্ভরিতা, জেদ এবং কপটতা মার খেয়েছে। তাই তো মানুষ সকলেই একত্রে রাজপথে নেমেছে বাংলাদেশের ‘শের-এ-বাংলা’দের অকৃত্রিম ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং অভিনন্দন জানাতে। কাউকে যখন দেখি না দেশের ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার সময় সামান্য শুভেচ্ছা জানাতে, তারা যখন ভবিষ্যত প্রজন্মের কথাই চিন্তা করে না, তারা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে হরতাল তুলে বিজয় মিছিল করতে চাইছেন? যদি কোন ঘটনা এই মিছিলের মধ্যদিয়ে না ঘটান, তবেই প্রমাণিত হবে আপনাদের সদিচ্ছার। আর যদি কোন অঘটন ঘটে তবে বুঝতে হবে, আপনারা এই আনন্দোচ্ছ্বাসের আড়ালে বিক্ষোভ প্রকাশ করার পথ খুঁজেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। এখানেও কি পলিট্রিক্স? দেশ ও জনগণকে সবার উপরে স্থান দেবেন, এমনটাই আমাদের আশা সকলের। মাহমুদউল্লাহর মূল্যায়ন আমরা সত্যিই আনন্দিত এ বিজয়েই নয়- যেভাবে খেলেছেন সবাই তাতেও। তামিম শেষ পর্যায়ে প্রচ- চাপে পড়া বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড় হয়ে যে ক্যাচটা মিস করেছেন সেটা অমার্জনীয় অপরাধ। বলটা এতক্ষণ আকাশে ছিল এবং সহজ একটা ক্যাচ তালুবন্দী না করাটা সত্যিই নিন্দনীয়। জানি তামিম ফিল্ডিংয়ে ভাল, তাহলে এই সহজ ক্যাচটা মিস করলেন কেন? তবে কি কোন টেনশন ছিল? ...একজন অজ্ঞ ক্রীড়া সম্পর্কিত সাংবাদিক হিসেবে যদি বলি তামিম একজন পুরনো ব্যাটসম্যান। অনেকে বলেন, দক্ষ ভাল ব্যাটসম্যান নাকি তিনি। তাহলে তার স্কোরবোর্ডটা দেখলেই তো প্রমাণ পাওয়া যাবে তিনি কখন কেমন করেছেন। খারাপ করেছেন পর পর, তারপরও তাকে দলে রাখা হচ্ছে। চোট পেলেন, তাকে অস্ট্রেলিয়া না কোথায় যেন পাঠিয়ে সুস্থ করে আনা হলো। এবার ৯৫ করে দলে রাখার যুক্তিটা জোরালো করেছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি বা আমরা অনেকেই মনে করি, অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যানকে বসিয়ে বিজয় ও সৌম্যকে দিয়ে ওপেনিং জুটি তৈরি করলে ভাল করবে। বোর্ডের একজন প্রভাবশালী পরিচালকের কারণে যদি তাকে দলে রাখতেই হয় তবে তিন-চারে খেলিয়ে দেখতে পারেন। যদি টেকে! অঙ্কে না মিললে তাকে বাদ দিলেই বা কী ক্ষতি? এবার দলে তো বেশ ভাল ব্যাটসম্যান, সীম এবং স্পিন বোলার এসেছেন। বর্তমানের দলটিকে মনে হচ্ছে যুৎসই। তবে একটু এদিক-ওদিক করলে ভালই হবে, মনে হয়। শাবাশ রুবেল! মাহমুদউল্লাকে হৃদ্যিক শুভেচ্ছা, মাহমুদউল্লাহ তাঁর নিজের ওডিআইতে প্রথম এবং বাংলাদেশের বিশ্বকাপেও প্রথম শতক হাঁকিয়েছেন দুর্দান্ত ব্যাটিং করে। তাঁর কৃতিত্ব অসাধারণ। ঐতিহাসিক এ বিজয়ে ওঁর এই সেঞ্চুরি নতুন ও ঐতিহাসিক মাত্রা যোগ করেছে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ শতরানের সুবাদে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কারও পেয়েছেন। যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছে বলেও আমরা মনে করি। মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উৎসর্গ নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফি বিন মুর্তজা আগেও একবার অধিনায়ক হয়েছিলেন কিন্তু পায়ের আঘাতের জন্য খেলা থেকে সরে থাকতে হয়েছিল বার বার। কিন্তু এবারে তিনি শুধু এলেনই না, একেবারে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলের অধিনায়ক মনোনীত হলেন। মাশরাফি দ্রুতগতিসম্পন্ন বোলার কিন্তু দক্ষ, প্রত্যয়ী অধিনায়কও যে তারও প্রমাণ দিলেন এবার। সময়োচিত প্রায়োগিক এবং বিচক্ষণতার অনুস্মরণীয় সিদ্ধান্তে তিনি দলকে বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তার বহুল আলোচিত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা এবং বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে দলকে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব আজ তাঁরই। এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক বিজয়কে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উৎসর্গ করেছেন। এছাড়া মাশরাফি পায়ের ব্যথা নিয়েই বল করেছিলেন। তিনি যখন হাঁটছিলেন তখন দেখছিলাম তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন, যখন বল করছিলেন তখন কিন্তু মনেই হচ্ছিল না, ওঁর পায়ে কোন খুঁত আছে। জান লড়িয়ে খেলেছেন মাশরাফি, তাই তো বোলিংয়েও তাঁর সাফল্য অনবদ্য। ভাষ্যকাররা তাঁর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন বার বার। মাশরাফিকে দেখলাম মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে সাক্ষাতকার দিয়েছেন। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের অপরাজেয় চৈতন্য তাঁকে যেন আরও বলিষ্ঠ ও চৌকস করে তুলেছিল। যে যতই অবজ্ঞা-অবহেলা করুক না কেন এবং বাংলাদেশকে উপরে ওঠার মতো দল নয় বলেও অনেকে তীব্র সমালোচনা করছিলেন। পাকিস্তানের রমিজ রাজা একজন ধারাভাষ্যকার হয়েও পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট ছিলেন, সব সময় বাংলাদেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই তাঁর কমেন্ট্রি করছিলেন। মাশরাফি ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে সে অবজ্ঞার জবাবই দেননি, রমিজকে চপেটাঘাতও করেছেন। বাংলাদেশ দলের জাতশত্রু ভারতের নবজোৎ সিধু সব সময়ই কেবলই গীবত গাইছিল ভারতের একটি চ্যানেলে খেলার মূল্যায়ন করার সময়। অথচ ভারতীয় সাবেক দুই তারকা ব্যাটসম্যান ও দক্ষ অধিনায়ক সুনীল গাভাসকার এবং সৌরভ গাঙ্গুলী বাংলাদেশকে সকল সময় উৎসাহ দিয়ে গেছেন। এই বিশ্বকাপেও। সুনীল গাভাসকার তো ভারতীয় অধিনায়ক ধোনিকে বাংলাদেশকে অবজ্ঞা না করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ব্রিটেনের পিটারসন চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছেন, এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, কিছুতেই না। বাংলাদেশ অসাধারণ খেলেছে, ভাল খেলেই জিতেছে। ইয়ান বোথাম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশের কিন্তু ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ও ধারাভাষ্যকার নাসির হোসেন বাংলাদেশের প্রচণ্ড সমালোচনা করেছিলেন খেলার ধারাভাষ্য দেয়ার সময়। ইংল্যান্ডের হয়ে একবার নয় বার বার। তাই বুঝি গায়ে জ্বালা ধরেছে নাসির হোসেনদের, সিধুদের, রমিজ রাজাদের? এটা ঠিক, বাংলাদেশের পারফরম্যান্স মাঝেমধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় তখন বাংলাদেশকে কেন ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ দেয়া হয়েছে, এ প্রশ্নও অনেকে তোলেন। এবারে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে এভাবে লড়াই করে ওঠার পর কী বলবেন ওঁরা? সতর্ক হতে হবে আমাদের এবারে আমরা যে পর্যায়ে উঠেছি, এখানে তো আমাদের অনেকটাই শক্ত-কঠিন হবে এগিয়ে যাওয়ার পথ। ১৩ মার্চ অর্থাৎ শুক্রবার আমাদের খেলতে হবে ‘এ’ গ্রুপের শীর্ষ দল নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে। ওঁরা অসাধারণ খেলছেন। সেখানে আমরা যে প্রবল শক্তি ও প্রত্যয়ী সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছি, কোন অঘটন না ঘটলে যে ফল আমরা আশা করব, তাতো নিশ্চয়ই বিজয়। তবে নিউজিল্যান্ড বলে কথা। তাই আমাদের মনটাকে বাঁধতে হবে শক্ত করে লড়াই করতে, যদি না পারি যেন আত্মমর্যাদা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারি। ক্রিকেট তো ‘সোনালি অনিশ্চয়তার খেলা’। কেউ কি বলতে পারে, কখন কে জিতবে? লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×