ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তির বেটি কাঁকন বিবি ভাল নেই, গেজেটে জোটেনি ‘বীরপ্রতীক’

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১২ মার্চ ২০১৫

মুক্তির বেটি কাঁকন বিবি ভাল নেই, গেজেটে জোটেনি ‘বীরপ্রতীক’

এমদাদুল হক তুহিন ॥ খাসিয়া সম্প্রদায়ের মুক্তির বেটি নামে পরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি খুব একটা ভাল নেই। ৮৫ বছর বয়স্ক এই নারী বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য কাঁকন বিবিকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন। দীর্ঘ ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা এখনও গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। ফলে জীবনের শেষ আশাটুকুও পূরণ হচ্ছে না কাঁকন বিবির। জীবনের শেষ সময়টা একটু সুখে শান্তিতে কাটানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ লাখ টাকার এফডিআর করে দেয় তাকে। ওই টাকার লভ্যাংশ পাচ্ছেন তিন মাস অন্তর অন্তর। ফলে নানা সঙ্কটে অনেক ক্ষেত্রেই সেবা শুশ্রুষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই লভ্যাংশের টাকা প্রতিমাসে দেয়ার দাবি রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই বীরপ্রতীক উপাধির গেজেট প্রকাশিত হবে এমন প্রত্যাশা তাঁর পরিবারের। দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে জীবনের শেষ আশা ত্যাগ করে কাঁকন বিবি বেছে নিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন কয়েকবার। তবে যুদ্ধ শেষে কোন এক অভিমানে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু তাঁকে ভিক্ষারত অবস্থায় খুঁজে পান। মিডিয়ায় আসেন তিনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁকন বিবিকে এক একর খাস জমি ও বীরপ্রতিক উপাধি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বর্তমানে ওই জমিতেই ছোট্ট কুড়ের ঘরে বসবাস করেন। তবে দীর্ঘ ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বীরপ্রতীক উপাধির গেজেট প্রকাশিত হয়নি আজও। বেসরকারীভাবে কাঁকন বিবি প্রথম স্বীকৃতি পান ১৯৯৮-তে জনকণ্ঠের দেয়া সংবর্ধনায়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এককালীন অর্থসহ প্রতি মাসে সম্মানী দিত জনকণ্ঠ। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লিপুর ইউনিয়নের জিরারগাঁও গ্রামে মেয়ে সখিনা বিবির সঙ্গে বসবাস করছেন। ৮৫ বছর বয়সী এই প্রৌঢ়াকে সরকারের পক্ষে জনতা ব্যাংকের ছাতক শাখায় ১৫ লাখ টাকার এফডিআর করে দেয়া হয়। ওই টাকায় প্রতি মাসে লভ্যাংশ আসে ৭ হাজার টাকা। তিন মাস অন্তর অন্তর ২১ হাজার টাকা করে দেয়ায় আর্থিকভাবে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পরিবারকে। সম্প্রতি কাঁকন বিবি ও তাঁর পরিবারে সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপে উঠে আসে কাঁকন জীবনযুদ্ধের নানা কষ্ট। কেমন আছেন প্রশ্নে কাঁকন বিবির ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সাফ সাফ উত্তর, ভাল আছি। একটু থেমেই আবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, শরীরটা ভাল নেই, নানা অসুখ। তাঁর একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবি ও মেয়ের জামাই রফিক মিয়ার কথোপকথনে জানা গেল খুব একটা ভাল নেই এক সময়ের সাহসী এই নারী। সখিনা বিবি জনকণ্ঠকে বলেন, মা খুব একটা ভাল নেই, বয়স হলে যা হয়। মাকে রোগে ছাড়ে না। ইদানীং প্রেশার বেশ ওঠানামা করে। ব্যাংকে জমা রাখা টাকা থেকে তিন মাস পর পর একসঙ্গে ২১ হাজার টাকা পাই। প্রতি মাসের সাত হাজার টাকার অর্ধেকের বেশি চলে যায় ওষুধে। বীরপ্রতীক উপাধির সরকারী গেজেট এখনও হয়নি। অন্তত মরার আগে মা তার প্রাপ্য সম্মানটুকু চায়। কাঁকন বিবি সাহসী এক নারীর নাম ॥ কাঁকন বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাহসী নারীর নাম। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বেছে নেন গুপ্তচরবৃত্তির পথ। জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানী মিলিটারির তথ্য সংগ্রহ করে আনতেন, সরবরাহ করতেন মুক্তিবাহিনীর মধ্যে। তাঁর দেয়া তথ্যানুযায়ী একাধিক মিশনে জয়ী হয় মুক্তিবাহিনী। সাহসী এই নারী সরাসরি অংশ নিয়েছেন আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বলিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূরিনটিলা, আধারটিলাসহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে। জানা যায়, ১৯৭১ সালে জুন মাসে দোয়ারাবাজার সীমান্তে পাকবহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী হেরে গেলে অনেকের সঙ্গে আটক করা হয় কাঁকন বিবিকেও। দিনের পর দিন চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। থেমে যাওয়ার নারী ছিলেন না তিনি। প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসতে থাকেন। ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা রহমতের সঙ্গে। কাঁকন বিবিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর সঙ্গে। মূলত তাঁর নির্দেশেই বেছে নেন গুপ্তচরবৃত্তির পথ। কাঁকন বিবির সরবরাহকৃত তথ্য মোতাবেক অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কয়েকটি অপারেশন সফল হয়। তবে আবারও ধরা পড়েন তিনি, এবার বাংলাবাজারে। শুরু হয় তাঁর ওপর নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার। দীর্ঘ এক সপ্তাহ চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যা কলমের ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব! নারীত্বের স্পর্শকাতর স্থান ছাড়াও শরীরের কোমল স্থানে চলে পাশবিক ও পশুত্ব প্রকাশক নির্যাতন! অজ্ঞান অবস্থায় মৃত ভেবে নরপিশাচরা তাঁকে ফেলে রেখে যায় রাস্তার পাশে। সহ যোদ্ধাদের সেবায় ৭ দিন পর জ্ঞান ফিরে এলে বলাট সাব সেক্টরে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করানো হয়। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে আবারও দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় প্রশিক্ষণ নেন অস্ত্র চালানোর। শুরু করেন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। জয়ী হয় বাংলাদেশ। তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যতীত আর কোন জয় দেখেননি তিনি! প্রায় ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার কর্তৃক ঘোষিত বীরপ্রতীক উপাধির স্বীকৃতি মেলেনি, প্রকাশিত হয়নি গেজেট। কাঁকন বিবির দেখাশোনা করেন এ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, উনার অনেক বয়স হয়েছে। বর্তমানে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। ৯৬ সালে উনাকে বীরপ্রতীক উপাধি দেয়া হয়, পত্র-পত্রিকায় তাকে বীরপ্রতীক হিসেবে বলা হলেও গেজেট এখনও প্রকাশিত হয়নি। এত বছর পেরিয়ে যাওয়া, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক!
×