ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তীব্র যানজট ও গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত ঢাকার পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ মার্চ ২০১৫

তীব্র যানজট ও গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত ঢাকার পরিবেশ

শাহীন রহমান ॥ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগরী ঢাকা। সোয়া কোটি মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত থাকলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে বরাবরই উঠে আসছে ঢাকা শহরের নাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যাবহুল ঢাকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি ছাড়া কমছে না। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে চাহিদা। কিন্তু ঢাকা দু’ভাগে বিভক্ত করেও মিলছে না কাক্সিক্ষত নাগরিকসেবা। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৮ হাজার মানুষ বাস করে। যে বিবেচনায় ঢাকা শহর বারবারই বসবাসের অযোগ্য তালিকায় উঠে আসছে, দিন দিন তা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। কিন্তু কেন বারবার ডার্টি শহরের মধ্যে ঢাকার নাম উঠে আসছে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ অপরিকল্পিত নগরায়ন, বর্জ্য অপসারণে অব্যবস্থাপনাসহ বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে খুব খারাপ অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাপক দূষণের কারণে ঢাকার নদীগুলো ব্যবহারে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দখলের কারণে ঢাকার খাল ও নদী হারিয়ে গেছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইচ্ছে করলেই ঢাকা শহরকে একটি পরিচ্ছন্ন নগরীর স্বর্গে পরিণত করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার নগরাঞ্চলীয় অবকাঠামোটি বিশ্বে সর্বোন্নত হলেও দূষণ, যানজট এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যথেষ্ট পরিষেবার অভাবে শহুরে সমস্যাগুলো প্রকট। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ঢাকার পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণপূর্ত ব্যবস্থায় যে আধুনিকীকরণ হয়েছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্তমানে এই শহর প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ টানতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। সারাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকায় আসে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে। এ কারণে ঢাকাও হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী। অথচ গুটিকয়েক পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় ঢাকার নাম উঠে আসছে। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক জরিপে ২০১৪ (সালে) যুক্তরষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স এ্যান্ড ইনডেক্সে বিশ্বের ১৭৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৯ উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব দেশের সার্বিক পরিবেশ ও জীবন মানেই এ সূচকে শুধুমাত্র বায়ু দূষণের কারণেই বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে ১৭৮তম। অর্থাৎ বায়ু দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয় পরিবেশ সমীক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও আনুষঙ্গিক সমস্যায় জর্জরিত। যা পরিবেশগত উন্নতির ভাবনা থেকে তাদের সরিয়ে রেখেছে। দরিদ্র দেশগুলোতে শক্তির ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকার কারণে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী খাল দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার বায়ু দূষণ। পরিবেশ অধিদফতরের হিসেবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বায়ু দূষণের পরিমাণ ৫০ গুণের বেশি রয়েছে। রয়েছে শব্দ দূষণ। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন ঢাকা শহরের চারপাশের ইটভাঁটি, তীব্র যানজট, পুরনো মোটরগাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং ধূলা। এ সব মিলিয়ে ঢাকার পরিবেশ এখন রীতিমতো অস¦স্তিকর। তাদের মতে, সারাদেশে কমবেশি ১০,০০০ ইটভাঁটি রয়েছে এবং এর প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ঢাকা শহরের আশপাশে। সেকেলে পদ্ধতির এ সব ইটভাঁটিতে পোড়ানো হচ্ছে। পরিবেশ সংগঠন পবার সাম্প্রতিক এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে বৈধ ও অবৈধ মিলে ইটভাঁটির সংখ্যা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার। কিন্তু এর ৬৭ ভাগই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ সব ইটভাঁটির কোন পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেকেলে পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এছাড়াও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকা মোটরগাড়ি থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড ঢাকার বাতাসকে করে তুলছে আরও ভারী। বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যৌথ গবেষেণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ঢাকার বায়ূ দূষণের মাত্রা এতো বেশি যে, বাতাসে এখন প্রতি কিউবিক মিটারে এয়ারবোর্ন পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার থেকে পাঁচগুণ বেশি (সহনীয় মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম)। নিউইয়র্কভিত্তিক ‘মার্চার হিউম্যান রিসোর্স কনসাল্টিংস’ নামের একটি সংস্থার স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক এক গবেষণা সমীক্ষায় ২০০৭ সালের মূল্যায়নে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহরের তালিকায় দ্বিতীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত যে সব জরিপ হয়েছে ঘুরে-ফিরে ঢাকা শহরের নাম সবার ওপরে এসেছে। কখনও প্রথম আবার কখনও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা। বায়ু দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা সুবিধা, পয়োঃনিষ্কাশন, ঘনবসতি এবং সংক্রামক রোগ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাবকে পরিমাপক ধরে এ সব সমীক্ষা চালানো হয়। প্রতিবেদনে ঢাকা সম্পর্কে বলা হয় বিশ্বব্যাংকের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তীব্র যানজট ও গাড়ির কালো ধোঁয়া ঢাকার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডাম্পিং হয় ৩ হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন। বেসরকারী জরিপ মতে প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৯শ’ ৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেডিক্যালসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। রাস্তাঘাট থেকে উৎপাদিত হয় ৪শ’ মেট্রিক টন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রতিবছর যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হয় তা ভারতের আগুয়াদা ইনফ্রা পাওয়ার প্লান্ট থেকে ২০ গুণ বেশি। এ বিদ্যুত কেন্দ্রে বছরে ১ লাখ টন সংগৃহীত বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। সে হিসেবে ঢাকা শররের সংগৃহীত বর্জ্য দিয়ে ২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা যেতে পারে। বর্জ্যরে কারণে ঢাকার সার্বিক পরিবেশগত ও স্বাস্থঝুঁকি দেখা দিলেও বিশ্বের বহু জায়গায় এখন বর্জ্য ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের কারণে জার্মানী, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নরওয়েসহ পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এখন বর্জ্যরে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে তারা পার্শ্ববর্তীদেশ থেকে বর্জ্য আমদানি করছে। এছাড়াও আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত বর্জ্য থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুত উৎপাদন করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমাচ্ছে। অথচ ঢাকাকে যে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে তার জন্য অনেকাংশে এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দায়ী।
×