ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশঘরের গান ছায়ানটে

নাইল্যা বেইচ্যা ধইল্যারে ঘাটুর লাইগ্যা যাইওরে...

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৪ মার্চ ২০১৫

নাইল্যা বেইচ্যা ধইল্যারে ঘাটুর লাইগ্যা যাইওরে...

মোরসালিন মিজান ॥ লোকগান। শহুরেদের জন্য। নকল কিছু নেই। বিকৃতি বা বাড়াবাড়ি অনুপস্থিত। লোকগান যা, সেভাবেই গাওয়া হলো। মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। শুধু কি শোনা? গানের বাণী, গভীরতর ভাব- সবই নিংড়ে দেয়া নেয়া হলো। অনবদ্য এ আয়োজন ছায়ানটের। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের কিংবদন্তি পুরুষ সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের চাওয়া পূরণে নিয়মিতভাবে এ আয়োজন করা হয়ে আসছে। আয়োজনটি সম্পর্কে এখন সকলের জানা। হ্যাঁ, দেশ ঘরের গান। ওয়াহিদুল হকের জন্মদিন ১৬ মার্চ সামনে রেখে শুক্রবার ছায়ানট মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথমেই ছিল আলোচনা। ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন ডা. সারওয়ার আলী ও শামসুজ্জামান খান। সূচনা বক্তব্যে দেশ ঘরের গানের মাধ্যমে ওয়াহিদুল হককে স্মরণ করার কারণ ব্যাখ্যা করেন ডা. সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, ওয়াহিদুল হক রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা রবীন্দ্র চর্চায় বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। এ জায়গাটিতে তাঁর নাম আলাদা করে উচ্চারিত হয়। তবে একই সঙ্গে বাংলার লোকগানের প্রতি ওয়াহিদুল হকের ছিল গভীর আগ্রহ। সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। লোকসঙ্গীত শুনেছেন। সংগ্রহ করেছেন। বাংলা সংস্কৃতির আদিরূপ লোকগান শহরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। লোকগানের শিল্পী সাধকরা মানুষের নানা অনুভূতি নিয়ে কাজ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মৌলবাদী, ধর্মীয় গোঁড়ামি কূপম-ূকতাকে তাঁরা কখনও প্রশ্রয় দেননি। এই ধারার গানের চর্চা বাড়ানো গেলে সমাজের গভীরে যে ক্ষত তা দূর হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। পাশাপাশি সেই পুরনো দুঃখবোধ তুলে ধরে ডা. সারওয়ার বলেন, স্বাধীনতার পর লোকগীতি নাগরিক সংস্কৃতির অংশ হওয়ার পর থেকে এর সুর বাণী বিকৃত করা হচ্ছে। এখনও তা অব্যাহত। একে অপরাধমূলক কাজ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। আলোচনায় অংশ নিয়ে লোকসংস্কৃতির গবেষক শামসুজ্জামান খান বলেন, লোকসংস্কৃতির পুরোটাই আঞ্চলিক ও জাতি তাত্ত্বিক। লোকগীতি জাতির আত্মা। সেই আত্মার সংস্কৃতি আত্মার গানের চর্চা বেশি বেশি করে করতে হবে। তবে তাঁর বক্তৃতা ছিল দীর্ঘ। সেমিনারে প্রবন্ধ পড়ার মতো করে বলে যান শামসুজ্জামান খান। ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠানে এমনটি হয় না বললেই চলে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সন্জীদা খাতুন এদিন তেমন কিছু আর বলতে পারেননি। ছোট্ট করে তিনি বলেন, ওয়াহিদুল হক দুটি বিষয়ে বিশেষ নজর ছিল। প্রথমটি হচ্ছেÑ শুদ্ধ সঙ্গীত। দ্বিতীয়টিÑ দেশ ঘরের গান। সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা যত গভীর হয়েছে ততোই তিনি লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। ওয়াহিদুল হক শহুরেদের এই দেশ ঘরের গান শোনাতে চাইতেন। জীবিত অবস্থায় তাঁর সেই স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারিনি। হয়ে উঠেনি। এখন সে চেষ্টাটি করা হচ্ছে। আলোচনা শেষে শুরু হয় মূল পরিবেশনা। এবার দৃশ্যমান হয় চমৎকার কুঁড়ে ঘরের আদলে সাজানো মঞ্চ। প্রথমেই সুর তুলে বাঁশি। সেই সুর অনুসরণ করেন এরফান হোসেন। তাঁর গাওয়া ‘শোন বলি সই কই গেলা কই’ গানটি বেশ উপভোগ করেন শ্রোতা। পর পরই ছিল আরও একটি একক গান। পরের পরিবেশনাগুলো আরও বেশি আকর্ষণীয়। অনুষ্ঠানে বিলুপ্ত প্রায় ঘাটু গানের পরিবেশনা নিয়ে আসে নেত্রকোনার কেন্দুয়া অঞ্চলের শিল্পীরা। দলীয় পরিবেশনার আগে ছিল গুরু শিষ্য ধারার গান। এ পর্বে গানে গানে গুরুর কাছে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে হাজির হন শিষ্য। সেই সব জিজ্ঞাসার চমৎকার জবাব দেন গুরু। এবারও গানে গানে। এর পর শুরু হয় ঘাটু গান। এবার মঞ্চে দেখা যায় দুই প্রধান চরিত্র ঘাটু ও সৌখিনদারকে। প্রথমে দেখা যায় ঘাটুর বিরহে বাঁশি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সৌখিনদার। তাঁর আকুতি প্রকাশ করে শিল্পীরা গাইছেনÑ নাইল্যা বেইচ্যা ধইল্যারে করলাম হরু বেইচ্যা খাই/ওরে তিলে বেচিয়া ধূতি চাদর ঘাটুর লাইগ্যা যাইওরে/নাইল্যা জলে করল তল...। এভাবে গানে গানে এগিয়ে চলে গল্প। ঘাটু গানের রীতি অনুযায়ী, এদিনও ঘাটু সাজেন একজন পুরুষ সদস্য। নাম সুকন। মেয়েদের মতো সেজে চমৎকার অভিনয় করেন তিনি। সৌখিনদারের ভূমিকায় ছিলেন শামস রিপন। তাঁর পরিবেশনাও চমৎকার। বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের পালাও দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। বিখ্যাত এই পালা পরিবেশন করেন নড়াইলের দীনবন্ধু সরকার ও তাঁর দল। পাহাড়ী শিল্পীদের পরিবেশনাটিও ছিল উপভোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্পীদের পরিবেশনাটিকে আয়োজকরা বলেন- বন পাহাড়ের নৃত্যগীত। পরিকল্পনায় ছিলেন অনামিকা ত্রিপুরা। পরিচালনায় ছিলেন চ থ প্রু মারমা। অনুষ্ঠানে গান করেন নাদিরা বেগম ও চন্দনা মজুমদারের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরাও। ছায়ানটের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
×