ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

বার্ধক্য জয়ের সাধনা-বেঁচে থাকা যাবে ১৪২ বছর

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৫ মার্চ ২০১৫

বার্ধক্য জয়ের সাধনা-বেঁচে থাকা যাবে ১৪২ বছর

(১৪ মার্চের পর) বার্ধক্য জয়ে মানুষের সাধনা চলছে নিরন্তর। কিভাবে দীর্ঘ আয়ু লাভ করা যায় সে দিকে লক্ষ্য রেখে গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। গতকালের পর আজ শেষাংশ। চিরকাল বেঁচে থাকার কথা কেউ বলছেন না। তবে বিশেষজ্ঞরা ব্যাপারটা যেভাবে দেখছেন, তাহলো যেসব রোগব্যাধির কারণে আমাদের জীবনের আয়ু সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের বয়স বেড়ে যাওয়া বা বুড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। যেমন : ক্যান্সার, হৃদরোগ, ইমিউন ব্যবস্থার বৈকল্য, আলঝেইমার ইত্যাদি। সবাই জানেন যে, অধিক কোলেস্টেরোল, মেদবহুলতা ও উচ্চ রক্তচাপই হৃদরোগের প্রধান কারণ। ইঁদুরের ক্ষেত্রে র‌্যাপাইমাইসিন প্রয়োগ করে আয়ু বৃদ্ধির যে বিস্ময়কর ফল পাওয়া গেছে তা যেমনি চমকপদ তেমনি সম্ভাবনাময়। সত্তরের দশকে উদ্ভাবিত এই এন্টিবায়োটিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে গবেষকরা লক্ষ্য করেন, যেসব ইঁদুরকে এটি দেয়া হয়েছে সেগুলোর আয়ু যেগুলোকে দেয়া হয়নি সেগুলোর তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। বয়স্ক ইঁদুরকে এই যৌগ উপাদানটি দিয়েও দেখা গেছে ওদের বয়স বৃদ্ধির গতি মন্থর হয়েছে। এই সংক্রান্ত গবেষণার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত তা মানুষের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হলে বয়স্ক লোকেরা এমনকি ষাটোর্ধ কি সত্তরোর্ধ লোকেরাও সেই সুফল পেতে পারে যা ওই ইঁদুরগুলোর ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিভাবে কাজ করে র‌্যাপামাইসিন? ওটা ইঁদুর ও মানুষের দেহে ‘এমটিওআর’ নামক একটি জিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। দেহকোষগুলো কিভাবে এনার্জি গ্রহণ করে ও কাজে লাগায় সে ব্যাপারে এই জিনটি ট্রাফিক সিগন্যাল হিসেবে কাজ করে। খাবার যদি প্রচুর পরিমাণে থাকে, তাহলে পুষ্টি উপাদানগুলো শুষে নিয়ে নিজেদের ক্রমাগত সংখ্যাবৃদ্ধি করার জন্য জিনটি দেহকোষগুলোকে সবুজ সঙ্কেত দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। খাবার দুর্লভ হলে জিন নিশ্চুপ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী খাবার সময় না আসা পর্যন্ত দেহকোষ বৃদ্ধির ব্যবস্থাটি থেমে থাকে। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা যায় যে, ওদের দৈনন্দিন আহার কমিয়ে দেয়া হলে আয়ু প্রায় বছরখানেক বেড়ে যেতে পারে। আরও প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই জিনটি এনার্জি সম্পর্কিত অন্যান্য পথ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আয়ু বাড়িয়ে তুলতে পারে। জিনটি অধিকতর সক্রিয় অবস্থায় থাকলে দেহকোষগুলো পুষ্টি উপাদান প্রক্রিয়াজাত করে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বার্ধক্য প্রতিরোধে এ পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উপাদান যা নিয়ে গবেষণা চলছে। এতে আশাবাদের সঙ্গে যথেষ্ট সাবধানতাও আছে। কারণ এর আগে রেসভেরাট্রল উপাদান ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত তা অতখানি কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। রেসভেরাট্রল উপাদানটি আঙ্গুর ও রেডওয়াইনে পাওয়া যায়। অন্যদিকে র‌্যাপামাইসিন বুড়িয়ে যাওয়া নিরোধক একটি সার্কিট চালু করে দিতে পারলেও এটা স্পষ্ট যে এখনও তা যৌবনের ঝর্নাধারায় পরিণত হতে পারেনি। তাছাড়া এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন র‌্যাপামাইসিন প্রয়োগ করা ইঁদুরের ক্ষেত্রে শরীরের আকার গড় আকারের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ ছোট হয়ে গেছে। ‘এমটিওআর’ জিন নিয়ন্ত্রিত ইঁদুরের চোখে ছানি পড়ার এবং ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পুরুষ ইঁদুরের অণ্ডকোষের কাজ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এগুলো যথেষ্ট নৈরাশ্যের কারণ। আর মানুষের ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর র‌্যাপামাইসিন গ্রহণকারীদেরও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি দেখা গেছে। চোখে ছানি পড়ার আশঙ্কা আছে কিনা তা নিয়ে অবশ্য আরও গবেষণা চলছে। জিন নিয়ন্ত্রণ অন্য গবেষকরা মনে করেন যে দীর্ঘায়ু হওয়ার চাবিকাঠিটা রয়ে গেছে আমাদের জিনে। দেহকোষের জীবনচক্রে টাইমকিপার হিসেবে কাজ করে টেলোমিয়ার নামে একটা জিনিস। যতবার কোষের বিভাজন হয়, ততবার এটি ক্রোমোজমের ডিএনএকে কপি করে। আর সুতোর শেষপ্রান্তে বাঁধা গিঁটের মতো টেলোমিয়ার কপি করার প্রক্রিয়ার সমাপ্তির সঙ্কেত দেয়। সুস্থ দেহের অধিকারীদের ক্ষেত্রে টেলোমিয়ার হ্রস্বতা লাভ করলেও টেলোমেরেস নামে একটা এনজাইম টেলোমিয়ারকে খানিকটা দীর্ঘায়িত করে দিয়ে ভারসাম্য বিধান করে। ফলে কিছু কিছু ডিএনএ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু হাড়, লিভার ও ইমিউন ব্যবস্থার বৈকল্য বা সমস্যা যাদের আছে তাদের বেলায় টেলোমেরেস কাজ করে না। বার্ধক্যরোধের গবেষণায় নিয়োজিত বিজ্ঞানীরা এই অবস্থাগুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। তাঁরা মনে করেন এসব সমস্যা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে টেলোমেরেস ও টেলোমিয়ারের আচরণ সংশোধন করার উপায় বের করা গেলে সুস্থ স্বাভাবিক অথচ বুড়িয়ে যাওয়া লোকদের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োগ করা যাবে। সহজ অথচ অদ্ভুত কৌশল বার্ধক্য রোধের আরেক কৌশল নিয়েও বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কৌশলটা একটু অদ্ভুত। সেটা হলো নবীন রক্তের ক্ষমতা বা শক্তিকে কাজে লাগানো। কৌশলটা ইতোমধ্যে ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। দৈহিক দিক দিয়ে একত্রে জোড়া লাগা যমজ ইঁদুরের রক্তপ্রবাহ ব্যবস্থা যেমন অভিন্ন, এ ক্ষেত্রেও তেমনি একটি কমবয়সী ইঁদুর এবং একটি বুড়ো ইঁদুরকে একই রক্তপ্রবাহ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। দুটো ইঁদুরের আর সব কিছুই আলাদা আলাদা থাকে। শুধু তাদের রক্তপ্রবাহটা থাকে এক ও অভিন্ন। এতে কি লাভ হয়েছে? অবশ্যই হয়েছে। রহস্যটা কী? সেটা একটি নয়, একাধিক। তার মধ্যে অন্যতম হলো জিডি ১১ নামে একটি প্রোটিন যা কমবয়সী ইঁদুরের রক্তে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত অথচ বুড়ো ইঁদুরের রক্তে অতি বিরল। তার মানে কি এই যে দীর্ঘায়ু লোকদের রক্তে জিডি ১১ প্রচুর পরিমাণে থাকে কিংবা যাদের রক্তে এই প্রোটিনের মাত্রা কম, তাদের বয়সঘটিত রোগ যেমন হৃদরোগ, স্মৃতিবিভ্রম ও পেশীর ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা বেশি? বিজ্ঞানীরা এখন এগুলো খতিয়ে দেখছেন। শুধু জিডি ১১-ই যে বার্ধক্য প্রতিরোধের সম্ভাবনা বহন করছে তা নয়। ক্লোথো নামে এক হরমোন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, ইঁদুরের দেহে এর মাত্রা বাড়ানো হলে এর আয়ু ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। আরও দেখা গেছে, প্রতি ৫ জন মানুষের একজন ক্লোথো জিনের সংস্করণ বহন করে, যার বদৌলতে তাদের দেহে ক্লোথো হরমোনের পরিমাণ বাড়ে। এই শ্রেণীর মানুষ অন্যদের তুলনায় গড়ে তিন থেকে চার বছর বেশি বাঁচে। এখানেই শেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকে ড. জান ভ্যান ডিউরেন ইঁদুরের পেশী, চটি ও চোখ থেকে মুমূর্ষু কোষগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে তুলে ফেলে দিয়ে তাদের আয়ু বাড়িয়ে তুলেছেন। অবশ্য এই কৌশল নিয়ে এখনও সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাকি। সুতরাং দীর্ঘায়ু হওয়ার, বার্ধক্যকে অনেক দূর পিছিয়ে দেয়ার, যৌবনকে বহুদিন প্রলম্বিত রাখার অপার সম্ভাবনা ধারণ করে আছে বিজ্ঞান। ক্লোথো, জিডি-১১, টেলোমিয়ার, বার্ধক্যরোধক জিন মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের এখনও দীর্ঘ সময় বাকি। তেমনি বাকি র‌্যাপামাইসিন, জিন থেরাপি ও কোষসংযোজন কৌশল। কিন্তু তার মানে এই নয় এগুলো কোনটাই সাফল্যের মুখ দেখবে না। মানুষের বিজ্ঞান সাধনা যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন এই কৌশলগুলো সামগ্রিকভাবে কিংবা সেগুলোর কোন একটি বিস্ময়কর ফল বয়ে আনবে। (সমাপ্ত) সূত্র : টাইম
×