ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ধ্রুবতারা ওয়াহিদুল হক

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১৬ মার্চ ২০১৫

সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ধ্রুবতারা ওয়াহিদুল হক

বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও রাজনীতির অনন্য সাধারণ বিশ্লেষক ওয়াহিদুল হকের শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। প্রয়াণের অনেক বছর পরও অভাব অনুভূত হচ্ছে তাঁর। সমাজ যখন ঘুণে ধরা, রাজনীতি নিষ্ঠুর ঘাতক, যখন উগ্র-মৌলবাদী হামলায় রক্তাক্ত প্রগতিশীল চর্চা ও চিন্তার স্বাধীনতা খুন হচ্ছে, নির্বাসনে মানবিকতার বোধ- তখন ওয়াহিদুল হকের মতো বাঙালীর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করছে বাংলাদেশ। আজকের যে অমানিশা ঘোর দুর্দিন তা থেকে উত্তরণে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক কা-ারি ওয়াহিদুল হকের দেখানো পথে সমাধান খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। বহু প্রতিভার বিরল মানুষ ছিলেন ওয়াহিদুল হক। দুর্দান্তগতির বর্ণাঢ্য জীবন ছিল তাঁর। একাধারে তিনি ছিলেন সাংবাদিক, সংগঠক, শিল্পী ও সংগ্রামী। তাঁর সংগ্রামও ছিল বহুমাত্রিক। রবীন্দ্র চর্চায় জীবনের বিপুল সময় ব্যয় করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে শিক্ষিতজনের খ-িত অর্জন হিসেবে দেখেননি। একে তৃণমূল ও সুস্থ সংস্কৃতির সামগ্রিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। সংস্কৃতি নিছক নান্দনিক বিষয় ছিল না তাঁর কাছে। ছিল সত্যের অমোঘ উচ্চারণ। সংস্কৃতিবিহীন রাষ্ট্রকে তিনি স্বীকার করেননি। তেমনি অর্থহীন সংস্কৃতি চর্চারও বিরোধী ছিলেন। বাঙালী সংস্কৃতি বিকৃত করার অপচেষ্টা ও প্রকৃত চর্চা ভুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সকলকে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। রাজনীতি সমাজনীতি ইতিহাস সাহিত্য বিজ্ঞানÑ সব বিষয়ে তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ। প্রতিটি বিষয়েই অগাধ পা-িত্য ছিল তাঁর। বিদগ্ধ ওয়াহিদুল হক চারপাশের পরিবর্তন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। অসাধারণ দেখার চোখ ছিল। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ঘোরতর অনেক সমস্যার সমাধানের উপায় বলে দিতে পারতেন। আর তাই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এ সময়ে ঘুরে ফিরে আসছে ওয়াহিদুল হকের নাম। দেশের ক্রান্তিকালে, উগ্র-মৌলবাদ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সাহসী পুরুষ। মানবিক বোধ দ্বারা তাড়িত ওয়াহিদুল হক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবার আগে মানুষের কাছে ছুটে গেছেন। এভাবে গণমানুষের অস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজকের বাংলাদেশে তাঁর মতো সৎ যোগ্য ও কর্মক্ষম মানুষের বড় অভাব। ওয়াহিদুল হকের ঘনিষ্ঠজন সহযোদ্ধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়াহিদুল হকের শূন্যতা পূরণ হওয়া আসলেই খুব কঠিন। তিনি তেমনই একজন ছিলেন। উদারমনা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ও সাহসী সংগঠক ছিলেন তিনি। সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেছেন। গান শিখিয়েছেন। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এমন সংগঠক বা সংগঠন এখন নেই বললেই চলে। এখন গান নাচ ইত্যাদি যা কিছু আছে, বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক। এসবের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খুব সংশ্লিষ্টতা নেই। এই সুযোগে মৌলবাদ কূপম-ূকতা সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে। ওয়াহিদুল হকের সাহসিকতার উদাহরণ দিতে ১৯৬৪ সালে ফিরে যান তিনি। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ওয়াহিদুল হক যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা ভুলবার মতো নয়। সকলকে নিয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। প্রতিবাদী মিছিল করেছেন প্রেসক্লাব থেকে শাঁখারীবাজার পর্যন্ত। রাতে বন্দুক হাতে পাহারা দিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে এই সাহসী নেতৃত্বের বড় প্রয়োজন। কিন্তু তেমন কারও দেখা মেলে না এখন। এ কারণে উগ্র-মৌলবাদীরা টিএসসির মতো জায়গায় প্রগতিশীল চিন্তার লেখককে নির্মমভাবে খুন করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের যে কোন বিপর্যয়ের মুহূর্তে ওয়াহিদুল হকের শূন্যতা খুব বেশি অনুভূত হয় বলে জানান তিনি। একই শূন্যতার কথা জানিয়ে আরেক সহযোদ্ধা ডাঃ সারওয়ার আলী জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান, সে পাকিস্তানের সরকার আমাদের সংস্কৃতির ওপর খড়গহস্ত হয়েছিল। ভাষার ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু। ক্রমাগত তা সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে থাকে। এই আক্রমণের মুখে ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনসহ অন্যরা বাঙালী সংস্কৃতি চর্চা ও বিস্তারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে ’৬১ সালে ছায়ানটের জন্ম। ’৮০-এর দশকে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ গড়ে ওঠে। উভয় ক্ষেত্রে প্রাণপুরুষ কিন্তু ওয়াহিদুল হক-ই। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে যে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালী স্বাধীনতার পথে যাত্রা করেছিল, সে আন্দোলন প্রধানত ছিল জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক চরিত্রের। সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে জাতির পরিচয় নির্ধারিত হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি তাই সংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেন ওয়াহিদুল হক। তিনি বলেন, ওয়াহিদুল হক ছিলেন ঠিক উল্টো। সঙ্গীতকে আন্দোলনের অস্ত্র করেছিলেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে সংস্কারক হিসেবে প্রচুর কলাম লিখেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচন উত্তর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, তখন সাংবাদিকের দায়িত্বের বাইরে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচার চালিয়েছেন তিনি। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সমকালের আলোচনায় প্রবেশ করে তিনি বলেন, এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, এর প্রতিক্রিয়ায় ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা দানকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। হিন্দুদের অনেকেই নতুন করে দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্ত হয়ে এরা বাংলাদেশের চেতনা ও বাংলাদেশের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে, মুক্তচিন্তার ওপর আক্রমণ করছে। এ বাস্তবতায় ওয়াহিদুল হক অনিবার্য হয়ে উঠেন। ওয়াহিদুল হকের আরেক সহযোদ্ধা অধ্যাপক ড. শফিউদ্দীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়াহিদুল হক সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা, সাংস্কৃতিক সুরুচির পক্ষে কাজ করতেন। সেই সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সবাইকে সমবেত করতে চাইতেন। সংস্কৃতিকে তিনি প্রধানত বাঙালীর জাতিগত ঐক্য তৈরির হাতিয়ার মনে করতেন। রবীন্দ্র চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও লোক সংস্কৃতির ওপর খুব জোর দিতেন তিনি। আজ এসবের অনেক কিছু থেকেই যেন সরে এসেছি আমরা। ওয়াহিদুল হক নেই। হয়ত তাই বাঙালী জাতিসত্তার ঐক্যের জায়গাটি নানাভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। দূর গ্রামের লোকশিল্পীদের আমরা এখন আমাদের ভাবতে পারি না। এসব ঘাটতি ঘুরে ফিরে ওয়াহিদুল হকের না থাকাকে স্মরণ করিয়ে দেয় বলে জানান তিনি। এখন যারা সংস্কৃতি চর্চা করেন তাঁদের মাঝে বাঙালীর ব্যাপক ঐক্যের চিন্তার ঘাটতি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রামকে মেলানো, মানুষকে মেলানো, গ্রাম ও শহরকে একসূত্রে গাঁথার কাজে ওয়াহিদুল হক ছিলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মতো করে কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে, শূন্যতা অনুভূত হওয়ার পাশাপাশি আছে ওয়াহিদুল হককে ভুলে থাকার আত্মঘাতী প্রবণতাও। সাধারণ সংস্কৃতিকর্মী এমনকি সংশ্লিষ্টদের অনেকেই ওয়াহিদুল হককে বেমালুম ভুলে থাকেন। জন্ম-মৃত্যু দিবসে কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও তাঁকে ধারণ করার মতো সমাজ আজও হয়নি। ওয়াহিদুল হকের কোন স্বপ্নই কেবল তাঁর ছিল না, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য ভাবতেন তিনি। তাঁর সেই ভাবনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ এখন হয় না। নতুন নতুন যেসব সঙ্কটের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ, সেসব থেকে মুক্ত হতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে ওয়াহিদুল হককে ধ্রুবতারার মতো অনুসরণের আহ্বান জানান বিদগ্ধজনেরা।
×