ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাশকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এখনই সময় ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৬ মার্চ ২০১৫

নাশকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এখনই সময় ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস-নাশকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। রাজনীতির নামে জঙ্গীবাদী তৎপরতা, সন্ত্রাস, নাশকতা, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যাসহ নানাভাবে দেশের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। যারা দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, যারা মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে চায়, দেশকে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেয়Ñ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। আর এক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। রবিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের যে কোন ধরনের বাধা অতিক্রম করে সারাবিশ্বে বাঙালী জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শক্তি ও সাহস যুগিয়ে যাবে। ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ। আলোচনায় অংশ নেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো. শাহিনুর রহমান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি এমপি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুজ্জামান খান এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুরা হোসেন। কানায় কানায় পরিপূর্ণ সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এরপর বিশাল বিশাল চারটি ডিজিটাল স্ক্রিনের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বজ্রনির্ঘোষ ভাষণটির ভিডিও প্রচার করা হয়। এরপর বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ’ এবং জি মওলা সঙ্কলিত ১২টি ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং তাঁর জীবন পরিচয় বিষয়ক গ্রন্থ ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি) মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনারসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট ও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরদিন জাগ্রত হয়ে থাকবে। গত ৪৪টি বছর ধরে ঐতিহাসিক এই ভাষণটি বেজেই চলেছে, কিন্তু আজও ওই ভাষণের আবেদন এতটুকুও কমেনি। যখনই এই ভাষণটি বাজানো হয়, তখনই বাঙালী জাতি নতুন করে জাগ্রত হয়, অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে আর একটি ভাষণও নেই, যে ভাষণটি গত ৪৪ বছর ধরে মানুষ শুনছে, বাজানো হচ্ছে। ভাষণটি কত কোটিবার, কত মাস, কত ঘণ্টা, কত সময় ধরে বেজেছে, কত কোটি মানুষ শুনছে, তার হিসাব কেউ বলতে পারবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন শ্রেষ্ঠ ভাষণ মানুষ এতবার শোনেনি। ৪৪ বছর পর আজও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে তোলে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস ও শক্তি যোগায়। ৭ মার্চ ভাষণ প্রদানের আগে কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ভাষণ দেয়ার আগে অনেকেই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। আমার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রাজনীতির ক্ষেত্রে পর্দার আড়ালে থাকলেও দেশের স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে তাঁর অপরসীম অবদান, প্রজ্ঞা কোনদিন জাতি ভুলবে না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতে যেতেন, তখন আমার মা তাঁকে কিছু সময়ের জন্য সবার থেকে আলাদা করে নিয়ে একান্তে চিন্তা করার সুযোগ দিতেন। ৭ মার্চের ভাষণের আগেও আমার মা তাই-ই করেছেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে অনেক নেতা অনেক পরামর্শ দিয়েছেন এবং নানাভাবে কথা হয়েছে। আমার মা বঙ্গবন্ধুকে কিছু সময়ের জন্য তাঁর ঘরে নিয়ে যান এবং বলেন, একটু একান্তে চিন্তা কর। তোমার ওপর লাখো মানুষের জীবন ও ভাগ্য নির্ভর করছে। দেশের স্বাধীনতা নির্ভর করছে। তাই কে কী বলবে বা পরামর্শ দিল তা বাদ দিয়ে দেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে তোমার মন থেকে যা বলার দরকার তাই-ই বলবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণই দিয়েছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে শুধু দেশের স্বাধীনতাই নয়, স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বারংবার ভাষণটি প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রণাঙ্গনে যুদ্ধরত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে অসীম সাহসী, দৃঢ় মনোবল এবং দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ’৭৫ পরবর্তী ২১টি বছর কার্যত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। ওই ২১টি বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাতে দেয়নি। ভাষণটি বাজাতে গিয়ে আমাদের বহু নেতাকর্মীকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির আবেদন মুছে ফেলতে পারেনি, কোনদিন পারবেও না। মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালীর মহাকাব্য। এই মহাকাব্য হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এ মহাকাব্য রচনা সম্ভব ছিল। কেননা তিনিই এ ধারার সার্থক প্রতিনিধি ও প্রবর্তক। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু-স্বাধীনতা-বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তা, চির অবিচ্ছেদ্য। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। আর বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন চিরকাল থাকবে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটিও বাঙালীর হৃদয়ে চিরকাল জাগ্রত হয়ে থাকবে। চিরকাল বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত ও পুনরুজ্জীবিত করে যাবে এই ভাষণটি। আর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনা করে গিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে। তাই দেশের মানুষকে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও এই অমর ভাষণটি অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে, যাবেও।
×