ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি আগেই বিদেশ চলে গিয়েছিলেন, না আত্মগোপনে? নানা প্রশ্ন

সালাহউদ্দিনের হদিস নিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে না পুলিশ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ মার্চ ২০১৫

সালাহউদ্দিনের হদিস নিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে না পুলিশ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নিখোঁজ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের আচমকা হদিস মেলা বিচিত্র নয়। যেমনটি হয়েছিল যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন বেলার নির্বাহী পরিচালক রেজোয়ানা হাসানের স্বামী সিদ্দিকুর রহমানের বেলায়। মুজিবুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমানকে অপহরণের পর গুম করা হয়েছে বলে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সরকারবিরোধীদের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। সালাহউদ্দিন আহমেদ সত্যি সত্যিই বাংলাদেশে আত্মগোপনে থেকে দলের পক্ষে অবরোধ-হরতালের বিষয়ে বিবৃতি দিতেন, নাকি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার অনেক আগ থেকেই বা অনেক পর থেকে তাঁর নামে অন্য কেউ বিবৃতি দিয়ে আসছিল, প্রশ্ন উঠেছে সে বিষয়েও। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এদিকে সালাহউদ্দিনের স্ত্রী তাঁর স্বামীর হদিস করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সালাহউদ্দিন আহমেদের হদিস জানা যায়নি। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ আর বিভিন্ন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে হরতাল চলছে। এমন কর্মসূচী সফল করতে বহুদিন ধরেই অজ্ঞাত স্থান থেকে বিএনপির পক্ষে নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে বিবৃতি আসছিল। গত ১১ মার্চ সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ দাবি করেন, আমার স্বামী উত্তরার একটি বাসায় গোপনে অবস্থান করছিলেন। সেখানে থেকেই দলীয় কর্মকা- চালিয়ে আসছিলেন। গত ১০ মার্চ রাতে ডিবি পরিচয়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে বাড়ির মালিক ব্যাংক কর্মকর্তা হাবিব হাসনাত আমাকে পরদিন জানান। দেরিতে খবর জানানোর বিষয়ে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আগামী ৮ এপ্রিল সালাহউদ্দিনের হদিসের বিষয়ে দায়ের করা রিটের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে সালাহউদ্দিনের হদিস জানার চেষ্টা চলছে বলে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার বিকেল চারটায় সালাহউদ্দিন আহমেদের গুলশান-২ এর ৭২ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর ‘দ্য প্লাটিনাম রেসিডেন্সে’ ইউনিভার্সিটি টিচার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল সমবেদনা জানাতে যায়। সাক্ষাত শেষে সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ তাঁর স্বামীর হদিস করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তদন্তকারী একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সালাহউদ্দিন আহমেদকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া এবং এ সংক্রান্ত অভিযোগ করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ঘটনা ঘটার পর পরই কেন বাড়ির মালিক সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানাননি, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। হয়তো অনেক আগেই সালাহউদ্দিন আহমেদ বিদেশ পালিয়ে গেছেন! পালিয়ে যাওয়ার পর বা অনেক আগ থেকেই সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে দল বা অন্য কেউ অজ্ঞাত স্থান থেকে বিবৃতি দিয়ে আসছিল। এটি সালাহউদ্দিন আহমেদের গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়ে থাকার কৌশল হতে পারে। এছাড়া চলমান আন্দোলন চাঙ্গা করতে বা কূটনৈতিকভাবে রাষ্ট্র ও সরকারকে চাপে ফেলতে আত্মগোপনে থেকে এমন অভিযোগ করাও বিচিত্র নয়। এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিনের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া এবং রিয়াজ রহমানকে গুলি করে আহত করার পর তাঁর গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। মূলত কূটনৈতিকভাবে সরকারকে চাপে ফেলতেই ঘটনা দুইটি ঘটানো হতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় সালাহউদ্দিন আহমেদ নাটকের অবতারণা করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। আচমকা সালাহউদ্দিন আহমেদের হদিস মেলাও বিচিত্র নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় কোন্দল, কোন অপহরণকারী গ্রুপ বা বিশেষ কোন গোষ্ঠী কর্তৃক সালাহউদ্দিন আহমেদকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া বা স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়েও এমন নাটক সাজানো হতে পারে। আবার সালাহউদ্দিন আহমেদের আচমকা হদিস মেলাও বিচিত্র নয়। যেমনটি হয়েছিল যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান ও বেলার নির্বাহী পরিচালক রেজোয়ানা হাসানের স্বামী সিদ্দিকুর রহমানের বেলায়। গত বছরের ৪ মে বিকেলে সুনামগঞ্জ থেকে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারযোগে সিলেট শহরে যাওয়ার পথে সুনামগঞ্জ বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও যুক্তরাজ্য যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুজিবুর রহমান (৫৬) চালক রেজাউল হকসহ (৩২) জেলাটির টুকের বাজার বাসস্টেশনের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয় বলে অভিযোগ করা হয়। ৬ মে সুনামগঞ্জ সদর থানায় এ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। আর ৯ মে মুজিবুর রহমানের ভাগ্নি জামাতা অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম বাদী হয়ে ৭/৮ জনকে আসামি করে একই থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মুজিবুর রহমানকে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কারণে অপহরণ করা হতে পারে বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়। এমন ঘটনায় রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। এ ঘটনায় ৭ মে সুনামগঞ্জ শহরে মানববন্ধন এবং ৮ মে সুনামগঞ্জ জেলায় আধাবেলা হরতাল পালন করে জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো। ভয় পেয়ে সরকার রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে শেষ করে দিতেই দলটির নেতাদের একের পর এক অপহরণ করে গুম করে ফেলছে বলে বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। যুক্তরাজ্যের নাগরিক হওয়ায় কূটনৈতিকভাবে মারাত্মক বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ সরকার। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসের একজন উর্ধতন কর্মকর্তাকে বিষয়টির অনুসন্ধান করতে রীতিমতো সুনামগঞ্জ সফর করতে হয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন মাস পর গত বছরের ১৮ আগস্ট মুজিবুর রহমান ভর্তি হন গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে। তার হদিস মেলার খবরে আবারও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ওইদিনই ভোরে গাজীপুরের শালনা ব্রিজের কাছে কে বা কারা তাকে ও তার চালককে চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছেড়ে দেয় বলে মুজিবুর রহমানের বরাত দিয়ে শ্যালক ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন জানান। মুজিবুর রহমান চালককে একহাজার টাকা দিয়ে সুনামগঞ্জ পাঠিয়ে দিয়েছেন বলেও দাবি করা হয়। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় মুজিবুর রহমানের নিখোঁজ রহস্য। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার ১৫ বছর আগ থেকেই যুক্তরাজ্যের নাগরিক হিসেবে লন্ডনের ব্রিকলেনে সপরিবারে বসবাস করছিলেন মুজিবুর রহমান। যুক্তরাজ্যে তিনি যুবদল প্রতিষ্ঠা করেন। চালকসহ নিখোঁজ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী মুক্তি পরিষদের নামে যুক্তরাজ্য থেকে নানা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়া ২০০৩ সালে লন্ডনের ব্রান্ডি সেন্টারে যুবদলের এক সভায় দলের এক কর্মীকে শত শত মানুষের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় লন্ডনের আদালত মুজিবুর রহমানকে ৬ কারাদ- দেন। ২০০৪ সালের ২৯ এপ্রিল মুজিবুর রহমান লন্ডনের কেন্টের একটি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। কারামুক্তির পর নিয়মানুযায়ী আসামির ওপর নজরদারি করতে শরীরে বিশেষ যন্ত্র লাগিয়ে দেয় লন্ডন পুলিশ। জামিনে বের হওয়ার পর মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ সালে বিষয়টি প্রকাশ পায়। মাদক চোরাচালান নিয়ে পাকিস্তানী মাফিয়াদের সঙ্গে বিরোধ হয়। পাকিস্তানী মাফিয়াদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মেরে দেয়। এছাড়া ঘটনার প্রায় ১০ মাস আগে ব্রিকলেনের খুলকো মিয়া নামে এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকের কাছ থেকে একলাখ পাউন্ডে দি সেভেন স্টার বার নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনে নেন। বার কেনার পুরো টাকা পরিশোধ না করায় লন্ডনের আদালত মুজিবুর রহমানকে বার কেনার সমুদয় টাকা জরিমানাসহ পরিশোধ করার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে আদালত মুজিবুর রহমানের লন্ডন ত্যাগের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। পাকিস্তানী মাফিয়াদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মেরে দেয়া, লন্ডনের আদালত কর্তৃক বার কেনার সমুদয় টাকা জরিমানাসহ পরিশোধ করার নির্দেশে মুজিবুর রহমান আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে আসার দুই সপ্তাহ পরেই স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়ে অপহরণ নাটক সাজায় মুজিবুর রহমান।
×