ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চসিক নির্বাচন

প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগের জটিল সমীকরণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৯ মার্চ ২০১৫

প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগের জটিল সমীকরণ

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তফসিল বুধবার ঘোষিত হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে চট্টগ্রামে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নতুনভাবে নড়েচড়ে উঠেছেন। এদের সঙ্গে ভোটারদের মাঝেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা ও জল্পনাকল্পনা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র পদে দলীয় সমর্থন কে পাচ্ছেন তা এখনও অঘোষিত। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সমর্থকরা আশাবাদী তাদের কাক্সিক্ষত প্রার্থীই এ পদে মনোনয়ন পাবেন। অপরদিকে, বিরোধী ২০ দলীয় জোট এখনও নীরবতাই পালন করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ দলের পক্ষে বিএনপির কোন প্রার্থী নির্বাচন করবেন কিনা তা এখনও অস্পষ্ট। বিএনপি সমর্থিত বর্তমান মেয়র আগে নির্বাচনের আগ্রহ ব্যক্ত করলেও সাম্প্রতিক অর্থাৎ বিএনপির চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কোন মন্তব্য নেই তাঁর। তবে ইচ্ছা যে নেই তা নয়। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে মেয়র পদে সম্ভাব্য দু’জনের নাম আলোচিত হচ্ছে। এঁরা হলেন সোলায়মান আলম শেঠ ও মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে বিশেষ করে মেয়র পদে প্রার্থিতা রাখবে কিনা তা ভবিষ্যতের গর্ভে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক মহলের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এ নির্বাচন বয়কট করার সম্ভাবনাই বেশি। তবে তারা যদি অংশ নেয় সরকারদলীয় সমর্থনের প্রার্থীদের প্রেক্ষাপট হবে এক ধরনের। আর যদি তারা বয়কট করে সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হবে ভিন্ন। যদিও এ নির্বাচন অরাজনৈতিক এবং স্থানীয় পর্যায়ের। তবুও বাঘা বাঘা প্রার্থী হয়ে থাকেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় সমর্থনের। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ লাখের বেশিতে উন্নীত হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন কমিশন অফিস ইতোমধ্যে তাদের নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। বুধবার তফসিল ঘোষণার পর তা আরও জোরালো রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে সিনিয়র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল বাতেনকে। বুধবার সন্ধ্যায় তিনি জনকণ্ঠকে জানান, নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিলবোর্ড ও ব্যানার ফেস্টুনের মাধ্যমে যারা আগাম নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলেন তাদের স্ব স্ব উদ্যোগে ঐ সব নামিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যথা হলে আচরণবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, মেয়র ও কাউন্সিলর পদে আগ্রহী প্রার্থীরা আজ বৃহস্পতিবার থেকে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে পারবেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৮ মার্চ মনোনয়নপত্র জমাদানের দিনক্ষণ ধার্য করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আজ বৃহস্পতিবার থেকে প্রার্থীরা সময় হাতে পাচ্ছেন মাত্র ১০ দিন। স্বল্পতম এ সময়ের মধ্যে প্রার্থী হওয়া, স্ব স্ব দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করা, এরপরে নির্বাচনী প্রচারে নেমে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া কঠিন একটি ব্যাপার বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তারপরও যেহেতু তফসিল ঘোষিত হয়েছে সে অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রার্থীদের এগিয়ে যেতে হবে। এদিকে, এ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও জোটগত সমর্থনের বিষয়টি বিদ্যমান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান যেসব প্রার্থীর নাম আলোচিত হচ্ছে তারা সকলেই আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন ও কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম বহু আগে থেকেই নির্বাচন করার জন্য তাঁদের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা মাঠ পর্যায়ে প্রচারও চালিয়ে আসছেন। দলের হাইকমান্ড থেকে চূড়ান্ত সিগন্যাল পর্যন্ত বুধবার পর্যন্ত কাউকে দেয়া হয়নি। দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আর কয়েকদিনের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে বলে তাদের ধারণা। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর প্রার্থীদের যাবতীয় দিক বিবেচনায় এনেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এসব কিছু নির্ভর করছে এককভাবে দলীয় সভানেত্রী ও ১৪ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর। আওয়ামী লীগের এ চার প্রার্থী আগেও বলেছেন সর্বশেষ তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর বুধবারও বলেছেন তারা কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। দল যাকে চূড়ান্তভাবে সমর্থন দেবে তার পক্ষেই কাজ করবেন বলে আবারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তবে চট্টগ্রামে মেয়র পদে প্রার্থিতা নিয়ে দলের মধ্যে গ্রুপিং বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের জোটের এমপিরাও দ্বিধাবিভক্ত। সম্ভাব্য প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে শক্তিশালী কয়েক এমপির অবস্থান বেশ জোরালো। পক্ষান্তরে, নুরুল ইসলাম বিএসসি, আ জ ম নাছির উদ্দিন ও আবদুচ ছালামের প্রতিও কারও কারও নেপথ্য সমর্থন রয়েছে বলে আলোচনায় রয়েছে। তবে তা এখনও প্রকাশ্য নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ১৪ দলের সমর্থন পেয়ে গেছেন। এখন তিনি ওয়ার্ড থানা পর্যায় ও দলের ওয়ার্কিং ও বর্ধিত সভার সমর্থন লাভের জন্য তৎপর। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম এসে এ প্রসঙ্গে বলে গেছেন তৃণমূল পর্যায় থেকে যাদের নাম আসবে তিনি তাদের মধ্য থেকেই চূড়ান্তভাবে সমর্থন জানাবেন। সঙ্গত কারণে তৃণমূলের সমর্থনটি এখন ব্যাপকভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। এক্ষেত্রে মহিউদ্দিন চৌধুরী ইতোমধ্যে ১৪ দলের সমর্থন পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। চট্টগ্রামে মেয়র পদে প্রার্থিতার জন্য মূলত মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছেন আ জ ম নাছির উদ্দিন ও আবদুচ ছালাম। নুরুল ইসলাম বিএসসি আগে মহানগরীর কোতোয়ালি আসনের এমপি ছিলেন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ আসনটি জাতীয় পার্টিকে দেয়ায় তা তিনি মেনে নিতে বাধ্য হন। এবার তিনি মেয়র পদে প্রার্থী হতে চাইছেন এবং আলোচনায় রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ নিয়ে তার তেমন কোন জোরালো তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, সম্ভাব্য প্রার্থী চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামও এখন দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়েছেন। কেননা, তিনি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তার পদে আসীন রয়েছেন। মেয়র পদে লড়তে হলে সে পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। আবার আগামী এপ্রিলে তার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময়ও শেষ হচ্ছে। এ অবস্থায় ঘোষিত হয়েছে তফসিল এবং ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি আগেভাগে চউক চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করবেন কিনা এবং করলেও দলীয় সমর্থন মিলছে কিনা তা সবই অজানা রয়ে গেছে। অপরদিকে, আ জ ম নাছির উদ্দিন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির সহ-সভাপতি। দলের সভাপতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি মেয়র পদে সমর্থন আদায় করতে পারলে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির আগামী দিনগুলো হবে এক ধরনের। আর সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী মনোনয়ন পেলে তার পক্ষে কাজ করলে প্রেক্ষাপট হবে আরেক ধরনের। এসব নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা ও আলোচনার ডালপালা বিস্তার করে আছে নগরজুড়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষেও বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, সময় স্বল্প হলেও এ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট অংশ নিলে এবং না নিলে কাকে কিভাবে দলীয় সমর্থন দেয়া হবে তার সবই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তবে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় কেউ থামছেন না। এক্ষেত্রে দলীয় সমর্থন নিয়ে বরাবরের মতো নাগরিক কমিটির ব্যানারেই নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা রয়েছে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর। এ লক্ষ্যে তিনি নতুন করে নাগরিক কমিটি ওয়ার্ডভিত্তিক পর্যন্ত করার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিইসি মোড় এলাকায় নির্বাচনী অফিস হিসেবে ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন ভবনও ভাড়া নেয়ার কথাবার্তা ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। এখন শুধু বাকি রয়েছে দলের ওয়ার্কিং ও বর্ধিত সভার সমর্থন আদায়। চসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি জানিয়েছেন মেয়র পদে প্রার্থী হতে দলের সমর্থন প্রত্যাশী। তাঁর ছবি সংবলিত অনেক ব্যানার, পোস্টার ও বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে নগরীর বিভিন্ন স্থানে। ‘মেয়র পদে নুরুল ইসলাম বিএসসিকে দেখতে চাই’ এ স্লোগানে তাঁর পক্ষের নেতাকর্মীরা জনমত গঠনের চেষ্টায় নেমেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সবকিছু নির্ভর করছে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ওপর। দলীয় প্রধান চাইলে আমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হব। নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি রাজনীতির মানুষ। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাঠে নামতে সব সময়ই প্রস্তুতি থাকে। তিনি আবারও বলেন, দলীয় সমর্থনে কে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন সে ঘোষণা আসবে একমাত্র কেন্দ্র থেকেই। সম্ভাব্য প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন আগের মতোই এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক। দলের সমর্থন লাভের জন্য লবিং করে চলেছেন। মাঠ পর্যায়ে প্রচারে লিপ্ত রয়েছেন। তাঁকে নিয়ে পোস্টার ও বিল বোর্ডের ছড়াছড়ি রয়েছে। অপরদিকে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামও আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে সমর্থন পাওয়ার দাবিদার। তিনিও নগরীতে অনেক আগে থেকেই এক প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। বলা যায়, সবচেয়ে বেশি পোস্টার তাঁরই। তাঁর ব্যাপারে একটি কথা বুধবার চাউর হয়েছে। মেয়র পদে প্রার্থিতা প্রয়োজন হলে ছেড়ে দিয়ে প্রতিমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক। তার এ ইচ্ছার কথা নাকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হয়েছে। তবে এর শতভাগ সত্যতা কোন সূত্রে জানা যায়নি। আবদুচ ছালামও অপর নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসির মতোই প্রায় একই সুরে এ প্রসঙ্গে বলেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে চেয়ে আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকেই সমর্থন দেবেন তিনিই মেয়র প্রার্থী হবেন। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত তো সকলকেই মানতে হবে। নেত্রী যদি সমর্থন দেন তবে আমি মেয়র পদে প্রার্থী হব। চউক চেয়ারম্যান পদে থেকে কিভাবে নির্বাচন করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুচ ছালাম বলেন, এটি কোন সমস্যা নয়। মেয়র পদে দলের সমর্থন পেলে চউক চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে যাব।
×