ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তিন স্তরের বিশেষ কৌশল

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২০ মার্চ ২০১৫

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তিন স্তরের বিশেষ কৌশল

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে আগামীতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়নে বিশেষ কৌশল নেয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হবে তিন পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় প্রারম্ভিক একত্রীকরণ ও সমন্বয় অংশ হবে ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় সমন্বয় সাধন ও বাস্তবায়ন অংশ হবে ২০২১ সাল থেকে ২৬ সাল পর্যন্ত এবং তৃতীয় পর্যায় জীবন চক্র কর্মসূচী ও অন্যান্য কর্মসূচীর সমন্বয় অংশ হবে ২০২৬ সালের পরবর্তী সময়ে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের খসড়ায় বাস্তবায়নে এসব কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছে। কৌশলপত্র তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের লক্ষ্য হচ্ছে সকল যোগ্য বাংলাদেশীর জন্য এমন একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা দারিদ্র্য ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করবে এবং বৃহত্তর মানব উন্নয়ন, কর্মের সুযোগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া আরো দক্ষতার সঙ্গে ও কার্যকরভাবে সম্পদের ব্যবহার, সেবা প্রদান ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংস্কার সাধ, যা সমাজের চরম দারিদ্র্য ও সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত সদস্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকরভাবে জীবন চক্রের বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবেলা করবে। সেই সঙ্গে মধ্য আয়ের দেশে আমাদের উত্তরণ ঘটবে এটি মনে রেখেই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে। সুতরাং এর পরিকল্পিত বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাস্তবায়নের বিশেষ কৌশলগুলো হচ্ছে- পাঁচটি ক্লাস্টারে বিন্যস্তকরণ ॥ জাতীয় সামাজিক নিরাপত্ত কৌশলপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, বর্তমানে যে সকল মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে তাদেরকে পাঁচটি ক্লাস্টারে বিন্যস্ত করা হবে। প্রতিটি ক্লাস্টারের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকবে একটি মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব কর্মসূচীগুলোর নকশা প্রণয়ন ও কার্যকরী বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপূর্ণ হবে। ক্লাস্টারের থিমের সঙ্গে বলিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে এমন একটি মন্ত্রণালয়ই ক্লাস্টার সমন্বযের দায়িত্ব পালন করবে। প্রস্তাবিত থিমেটিক ক্লাস্টার প্রোগ্রামগুলো হচ্ছে, সোস্যাল এ্যালাউন্সেস, ফুড সিকিউরিটি এ্যান্ড ডিজাস্টার এ্যাসিসট্যান্স, সোস্যাল ইন্স্যুরেন্স, লেবার/লাভলিহুডস ইন্টারভেনশন এবং হিউম্যান ডেভলপমেন্ট এ্যান্ড সোস্যাল ইমপাওয়ারমেন্ট। এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে ২০১৫ থেকে ২০ সালের মধ্যে। আধা স্বায়ত্তশাসিত সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা গঠন ॥ সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের দ্বিতীয় পর্ব বাস্তবায়নের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রথম পর্বের মতো সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারভিত্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হবে। তবে একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা সমন্বয় ও তদারকির দায়িত্বে থাকবে। সরকারী কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, দারিদ্র্য ও নীতি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এ সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা গঠিত হবে। বিদ্যমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ মাঠ পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীগুলোর সমন্বয় বিধানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। এ পর্ব বাস্তবায়িত হবে ২০২১ থেকে ২৬ সালের মধ্যে। সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় গঠন ॥ তৃতীয় পর্বে জীবন চক্র কর্মসূচী পদ্ধতি ও অন্যান্য কর্মসূচী বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়েছে। এ অংশে বলা হয়েছে, জীবন চক্রভিত্তিক সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য একটি সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় গঠন করা হবে। যার আওতায় থাকবে নাগরিক পেনশন, প্রতিবন্ধী সুবিধা, শিশুদের জন্য সুবিধা (এতিম শিশুদের কর্মসূচীসহ), ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের সুবিধা কর্মসূচী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুবিধা কর্মসূচী। এছাড়া জীবনচক্রভিত্তিক কর্মসূচীর আওতাবহির্ভূত কর্মসূচীগুলো যেমন, পূর্ত কাজের কর্মসূচী, ওএমএস, দুর্যোগ-মোকাবেলা স্কিম ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো উদীয়মান ঝুঁকি ও বিপদের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের দাফতরিক এখতিয়ারের আওতায় নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচীর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। এই তিন কৌশলের পাশাপাশি কৌশল পত্রের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য হিসাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে আরো বিভিন্ন ব্যবস্থার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, সুবিধাভোগী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, এনজিওদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং আপীলের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও নির্ধারিত মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে দেশব্যাপী অভিযোগ, বিবাদ সমাধান করবে এবং তা নিরসনের ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্ব বিবেচনা করে ক্রমাগত এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। যা ছিল সরকারী ব্যয়ের প্রায় ১৬ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০-১১ অর্থবছরে এখাতে মোট বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তার পরের অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় মোট ২২ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এভাবে প্রতিবছরই বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারী বরাদ্দের পরিমাণ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ কর্মসূচীগুলোর সুফল সমানভাবে মিলছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে এর বিস্তৃতি, উপকারভোগীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, সম্পদের দুর্নীতি এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও নানা রকম বৈষম্য।
×