ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

বাংলাদেশ হারেনি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২১ মার্চ ২০১৫

বাংলাদেশ হারেনি

‘The Bangladesh Tigers have knocked the England Lions out of the World Cup. One of the greatest days in Bangladesh cricket history, one of the lowest points in English history.’ ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেইনের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো উপরের কথাগুলো। বড় কষ্টে, দুঃখে, ক্ষোভে কথাগুলো উচ্চারণ করতে হলো ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলের প্রাক্তন এই ক্যাপ্টেনকে। ৯ মার্চ ২০১৫। এডিলেডের ওভাল মাঠ। পুল ‘এ’-এর নির্ধারক ম্যাচে বিশ্ব ক্রিকেটের তিন মোড়লের অন্যতম ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছে বাংলাদেশ। ৪৯তম ওভারে রুবেলের আগুনের গোলায় উড়ে গেছে ইংল্যান্ডের শেষ দুই উইকেট এবং সেই সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের খেলবার সুযোগ। তারপরই নাসের হুসেইনের সেই উক্তি। ওভালের সেই ম্যাচে আরও ইতিহাস হলো। ৪২তম ওভারে ডানহাতি পেসার জিমি এন্ডারসনের বলে সোজা চার মেরে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারের সেঞ্চুরি করবার গৌরব অর্জন করলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। এরপর নিউজিল্যান্ডে হ্যামিল্টনের সেডন পার্ক মাঠে আবারও মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ড দলের টিম সউদি ও ট্রেন্ট বোল্টের বোলিং তোপে মাত্র ৩৩ রানে পড়ে গেছে বাংলাদেশের দুই উইকেট। এ সময় ত্রাতা হিসেবে এলেন মাহমুদুল্লাহ। ড্যানিয়েল ভিট্টরির বলে এক রান নিয়ে অর্ধশতক পূর্ণ করলেন তিনি। তারপর এলো সেই স্মরণীয় মুহূর্ত। ১১১তম বলে মিচেল ম্যাকক্লেনাঘানের বলে এক রান নিয়ে মাহমুদুল্লাহ বিশ্বকাপে পরপর দুইটি সেঞ্চুরি করার বিরল কৃতিত্ব দেখালেন। ৯ থেকে ১৫ মার্চ- এ সময়কালে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে মাহমুদুল্লাহর নাম উঠে গেল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে। ৪৩তম ম্যাচ পর্যন্ত রানের খাতায় শীর্ষ পাঁচজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে পঞ্চম হলেন বাংলাদেশের মাহমুদুল্লাহ। রান গড়ে তাঁর স্থান হলো দ্বিতীয়। গুরুত্বপূর্ণ আরও বিষয় হলো শীর্ষ পাঁচের মধ্যে দু’জন শ্রীলঙ্কার, যথাক্রমে কুমারা সাঙ্গাকারা ও তিলকারত্নে দিলশান। ঘনিষ্ঠ নৃগোষ্ঠীর তিনজন আছেন শীর্ষ পাঁচে। কিভাবে? সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আমরা’ কবিতার দু’টো চরণ আমরা স্মরণ করতে পারি এ প্রসঙ্গেÑ ‘আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয় সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।’ খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সিংহলী জনগোষ্ঠীর জেনেটিক সংবিন্ন্যাসে জিনের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি এসেছে বাঙালী নৃ-গোষ্ঠী থেকে; তা শতকরা ৭২ ভাগ। ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিংয়ের সবচেয়ে আধুনিক গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তা ছিল গভীর আনন্দের সংবাদ। বনেদী ক্রিকেটের দেশগুলো থেকে নয়, আমাদের মতো জনগোষ্ঠী থেকে শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে নিয়েছে তিনজন। মনে পড়ছিল পেছনের কথা, কষ্টের কথা। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ফাইনালে কেনিয়াকে পরাজিত করে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল জিতে নিয়েছিল কার্লসবার্গ আইসিসি ট্রফি এবং ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সহযোগী সদস্য হিসেবে খেলবার যোগ্যতা। সে অর্জন এসেছে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই। তাই বিশ্বকাপ চলাকালে ইংল্যান্ড ও বনেদী ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের ক্রিকেটবোদ্ধারা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওপর খুব বেশি সমালোচনামুখর হয়নি। তবে সুযোগ পেলেই দুটো উপহাসের বাক্যবাণ নিক্ষেপে পিছপা হতেন না তাঁরা। আমাদের ক্রিকেটাররা এবং আমরা অনেকটা নতমুখে তা শুনে গিয়েছি। প্রথম সেই বিশ্বকাপে অর্জন একেবারে কম ছিল না। শুধু স্কটল্যান্ডকে নয়, আইসিসির পূর্ণ সদস্য শক্তিশালী পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিল বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের পর আবার পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দ ছিল বাধভাঙ্গা। এরপর ২০০০ সালে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে খেলবার সুযোগ পেল। দেশে আনন্দের বন্যা বয়েছিল। যেমনটা বয়েছিল ১৯৯৭ সালেও। এবার আর রাখঢাক নেই। মুক্তকচ্ছ হয়ে ইংল্যান্ডের বরেণ্য ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার জেফ্রি বয়কট নানা উপলক্ষে বিদ্রƒপের তীক্ষè শেল নিক্ষেপ করতেই থাকলেন বাংলাদেশ নামের দরিদ্র, হতশ্রী দেশটির তাঁদের চোখে আনাড়ি, অপাঙ্ক্তেয় ক্রিকেট দলটির প্রতি। সে সমালোচনা পাকিস্তান ও ভারতের ক্রিকেট সমঝদাররাও করেছেন। সময়ের আগেই টেস্টে খেলবার মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ, এই সমালোচনা শুধু কি বাইরের ক্রিকেটবোদ্ধারা করেছেন? নিজেদের কাতারে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে মেনে নিতে তাঁদের কষ্ট হলে হতেও পারে। কিন্তু গভীর পরিতাপের কথা হলো উপহাস ও সমালোচনার বাক্যবাণ উচ্চারিত হয়েছে ভেতর থেকেও। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের স্বীকৃতি এসেছে বলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক বলয়ের বোদ্ধারা নির্দয় উক্তি করতে ছাড়লেন না। এমন কথাও তাঁরা বলেন যে, আমাদের ক্রিকেট টিম বা আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের যোগ্যতা নয়, আইসিসির প্রেসিডেন্ট কলকাতায় জন্ম নেয়া জগমোহন ডালমিয়ার বদান্যতা ও আনুকূল্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে বাংলাদেশ। বলবার কিছু নেই। এ হলো শিক্ষিত সুশীল বাঙালীদের আজন্ম-লালিত হীনম্মন্যতা। সে সবকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম এগিয়ে গেছে সামনে। টেস্ট ক্রিকেট খেলবার মর্যাদা পাওয়ার ফলেই বাংলাদেশের ছেলেদের সুযোগ হলো ক্রিকেটের বনেদী দলগুলোর সঙ্গে খেলবার। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে তিল তিল করেই। বাংলাদেশের ওই সব নিন্দুকরাও নিশ্চয়ই তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছেন পরে। বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা সোনার টুকরো ছেলেরা। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত। বিশ্ব ক্রিকেটের স্বঘোষিত তিন মোড়লের আর এক মোড়ল। কম উপেক্ষা পাইনি আমরা তাদের তরফ থেকে। এ পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে আমন্ত্রণও করেনি তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে হেরে শ্রীলঙ্কাকে বিদায় নিতে হয়েছে এবারের ক্রিকেট আসর থেকে; রইল বাংলাদেশ। তিন মোড়লের এক মোড়ল ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে তারা। এবার দ্বিতীয় মোড়ল ভারত বধের পালা। স্বপ্নপূরণে এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ইতিহাস সৃষ্টি করতে সামর্থ্যরে শেষ বিন্দু দিয়ে খেলেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের। ভারতের ইনিংসের ৪০তম ওভারের চতুর্থ বলটি ফুলটস দিয়েছিলেন রুবেল। বলটিতে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন রোহিত। কিন্তু লেগ আম্পায়ার আলিম দার বোলিং প্রান্তে থাকা ইয়ান গোল্ডকে ‘নো’ বলের সঙ্কেত দেন। ইংল্যান্ডের আম্পায়ার গোল্ড তখন ‘নো’ ডাকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। টিভি রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, বলটি কোমরের ওপরে ছিল না। তখন ধারাভাষ্যকার শেন ওয়ার্নও বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলটি খেলার সময় রোহিত ঝুঁকেছিলেন উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, ‘নো বল দেয়ার মতো যথেষ্ট উঁচুতে ছিল না বলটি।’ সৌরভ গাঙ্গুলির মতও ছিল তাই। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বেশ হতাশার উল্লেখ করে ওয়ার্ন বলেন, ‘আলিম দারের মতো একজন আম্পায়ারের কাছ থেকে এটা হতাশাজনক একটি সিদ্ধান্ত।’ সিদ্ধান্তটি দেয়ার পর মাঠে হতভম্ব হয়ে পড়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বিষয়টি আমলে নেননি। ক্যাচটি দেয়ার সময় ৯০ রানে থাকা রোহিত বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম শতক পান। ভারতের রান তখন ৩ উইকেটে ১৯৬। এর আগে অপর একটি আউট থেকেও বঞ্চিত করা হয় বাংলাদেশকে। মাশরাফির বলে পরিষ্কার লেগ বিফোর হন রায়না। আউট দেননি আম্পায়ার। রিভিউ চেয়েছিল বাংলাদেশ। তাতে পরিষ্কার দেখা গেল বল আঘাত করেছে স্ট্যাম্পকে, কিন্তু কয়েক সেন্টিমিটার আউট অফ পিচ বল পড়েছে, এই যুক্তিতে আউট দিলেন না তৃতীয় আম্পায়ার। তখন রায়নার রান ছিল মাত্র ১০। আম্পায়ারের এমন সব বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এলোমেলো হয়ে যায় তাদের ফিল্ডিং। যেখানে ভারতকে বেঁধে ফেলার কথা ২৫০ রানের ভেতর, তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০২। ম্যাচের ভাগ্য তখনই স্থির হয়ে যায়। ব্যাটিং বাংলাদেশের ভাল হয়নি। ৩০০ রানের পাহাড়কে সামনে রেখে লড়াই করা খুব সোজা তো নয়। তারপরও ভীত হয়নি বাংলাদেশ। এখানেও দুর্ভাগ্য। মাহমুদুল্লাহর ওভার বাউন্ডারি ধরতে গিয়ে শিখর ধাওয়ানের পা বাউন্ডারির রজ্জু ছুঁয়ে গেলেও তৃতীয় আম্পায়ার তেমন কোন সময় না নিয়েই আউট দিয়ে দেন মাহমুদুল্লাহকে। বিষয়টি কি এমন যে তিন মোড়লের অন্যতম ভারতকে হারতে দেয়া যাবে না। টুর্নামেন্ট থেকে ভারত বিদায় হলে সেমিফাইনাল-ফাইনালের ঔজ্জ্বল্য যে আর থাকে না। তবে বাংলাদেশকে সমীহ করেই খেলেছে ভারত। ভাবছিলাম অন্য কথাও। কত বছর পর ভারতীয় টিমে জায়গা করতে পেরেছিলেন বাঙালী সৌরভ গাঙ্গুলি। তাঁর অবসরের পর আরেকজন বাঙালীর স্থান কবে হবে ভারতীয় টিমে। অন্যদিকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ টিমে খেলছে ১১ জন বাঙালী। তাদের সমীহ করেই খেলতে হচ্ছে বাকি দলগুলোকে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে সে ভাগ্য তো আমাদের হতো না। শাবাশ বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। তোমরা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছ। আমরা তোমাদের নিয়ে গর্বিত। লেখক : শিক্ষাবিদ
×