ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজালালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে নৈরাজ্য ॥ লাগেজ বিড়ম্বনা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২১ মার্চ ২০১৫

শাহজালালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে নৈরাজ্য ॥ লাগেজ বিড়ম্বনা

আজাদ সুলায়মান ॥ সিঙ্গাপুরে একটি ৭৭৭ উড়োজাহাজের ৮০০ লাগেজ ডেলিভারি দিতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। যাত্রীরা ইমিগ্রেশন করে কনভয় বেল্টে পৌঁছেই দেখতে পান- লাগেজ ঘুরছে। কোন কারণে যাত্রীর একটু দেরি হলে দেখা যায় লাগেজ বেল্ট থেকে নামিয়ে রাখা হয়েছে। কুয়ালালামপুর, ব্যাঙ্কক, হংকং, দিল্লী এমনকি কলকাতায়ও একই সময়ে লাগেজ ডেলিভারি পাওয়া যায়। বিপরীতে ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে এ কাজটা সারতে কত সময় লাগে? জনকণ্ঠের অনুসন্ধান ও দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সমসংখ্যক লাগেজ ডেলিভারি দিতে সময় লাগছে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। আর যাত্রীরা ঢাকায় নেমে ইমিগ্রেশন শেষ করে বেল্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘ সময় ধরে। কখনই ৪০ মিনিটের আগে বেল্ট ঘুরতে শুরু করে না। শুরু হয় বিমানকে গালাগাল, ক্ষোভ প্রকাশ। বিমানবন্দরে নেমেই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয় বিদেশী নাগরিকদের কাছে। এ অবস্থাই চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শত সমালোচনা-লেখালেখির পরও ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের’ এই প্রক্রিয়ার কোন উন্নতি নেই। বাংলাদেশ বিমান পরিচালিত এই কাজের কেন উন্নতি নেই? এ প্রশ্নের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। বিমান কর্তৃপক্ষ বলছেন, এ সঙ্কট কৃত্রিম। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি এবং দুর্নীতির কারণেই অবস্থার উন্নতি করা যায় না। দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ লোকবল এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবেই বিমানের একমাত্র লাভজনক এ খাতের উন্নতি হচ্ছে না। বড়ানো যাচ্ছে না যাত্রীসেবা। বিমানবন্দরের দেশী-বিদেশী সব উড়োজাহাজের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজটা করে বিমান। বিষয়টি নিয়ে প্রচারমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের হয়রানি কমানোর লক্ষ্যে একাধিকবার নানা উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিদেশী প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানোর সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায়, তা বিমান কর্তৃপক্ষ পর্যালোচনা শুরু করেছে। কাজটি বিমানের হাতে রাখা হবে নাকি ছেড়ে দেয়া হবে, কোনটা করলে কতটা লাভ-ক্ষতি কী হবেÑ সেটা নির্ণয় করার জন্য কনস্ালট্যান্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ডাকা দরপত্রে অংশ নিয়েছে বিদেশী ১৮টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এটি করতেও সময় লাগবে মাসখানেক। তবে এবারও বাধা দেবে বলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বিমানের কর্মচারী ইউনিয়নগুলো। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিটি ফ্লাইটের লাগেজ ডেলিভারির কাজ কখনই ৪০ মিনিট আগে শুরু হয় না। ভাগ্যবানরা প্রথমেই পেয়ে যান। অন্যরা কখনও কখনও পান দুই ঘণ্টা পর। একই অবস্থা উড়োজাহাজ টেক অফের বেলায়ও। দেখা যায়- যাত্রীরা সব লাগেজ পুরে ক্যাপ্টেন ককপিটে বসে আছেন টেক অফের জন্য। লাগেজ ঢুকানো শেষ হচ্ছে না তাই উড়তে পারছেন না। আর লাগেজ কাটা, ছেঁড়া, হারানোর অভিযোগ আছেই। হারানো লাগেজ ফিরে পেতে যাত্রীকেই বার বার বিমানবন্দরে এসে খুঁজতে হয়। অথচ হারানো লাগেজ খুঁজে বের করে যাত্রীকে ডেকে এনে ফিরিয়ে দেয়া বিমানেরই বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। এসব কিছুই চোখে পড়ে না হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সব সরকারের আমলেই নেয়া হয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মান উন্নত করার উদ্যোগ। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে এখন নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটকেই দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাতে পরিস্থিতি মাঝে মধ্যে উন্নতি ঘটে। সময়মতো লাগেজ দেয়া সম্ভব হচ্চে। কিন্তু এভাবে জোড়াতালি দিয়ে কতদিন? এমন প্রশ্ন বিমানেরই। বার বার হুমকি দেয়া হয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার। আন্দোলনের হুমকির কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে এবার সত্যি সত্যিই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খাত জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বলে দিয়েছেন, জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে এখন সবাই একমত। সরকার চায়, মন্ত্রণালয় চায়, পর্ষদ চায়, এমনকি বিমানও চায়। চায় না শুধু ইউনিয়নগুলো। কারণ এটা তাদের কাছে টাকার খনি। এ জন্য তারা সবাই এই স্বার্থে এক। জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেয়া হলে এ স্বার্থ ক্ষুণœ হবে, তাই তারা চায় না। কারণ জয়েন্ট ভেঞ্চার নেয়া হলে লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই তারা চিন্তিত। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার বিরুদ্ধে বিমানের সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী, সব সিবিএ-ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছে নজিরবিহীন ঐক্য। তাদের বক্তব্য হচ্ছেÑ বিমান টিকে আছে এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের টাকায়। এত দুর্নীতি চুরি ও লুটপাটের পরও এই খাত থেকে বছরে আসছে কমপক্ষে ৫শ’ কোটি টাকা। তাদের ভাষায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং হচ্ছে বিমানের হার্ট। এই হার্টকে বাঁচানোর জন্য বিমানের কর্মচারীরা কেন তৎপর নয়, কিংবা এই সেবার মান উন্নয়ন করা যাচ্ছে নাÑ এ প্রশ্নে তাদের অভিযোগ, জনবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবেই তা করা যাচ্ছে না। বিমানবন্দরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন তথ্য-প্রমাণসহ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘বিদ্যমান জনবল এবং যন্ত্রপাতি দিয়েই এর চেয়ে অনেক ভাল সেবা দেয়া সম্ভব। আমি নিজে দিন-রাত বিমানবন্দরে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছি- বিশ মিনিটেও একটি ফ্লাইটের লাগেজ ডেলিভারি দেয়া সম্ভব। এ জনবল দিয়েই কাজ আদায় করে নিয়েছি। আসলে এখানে সবার মাঝে দায় এড়ানোর প্রবণতা। প্রত্যেক কর্মী যদি তাঁর নিজ দায়িত্বটুকু পালন করেন, তাহলেই এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, অনেকেই নিজের কর্মস্থল ছেড়ে দায়িত্ব পালন না করে অন্যত্র গিয়ে আড্ডা দেন। অনেককে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। কয়েকজনকে শাস্তিও দেয়া হয়েছে। কেমন চলছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ॥ টানা ছয় দিন বিমানবন্দরের পিক আওয়ারের চিত্র সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়Ñ জেদ্দা, লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাঙ্কক ও দিল্লীর প্রতিটি ফ্লাইট নামার পর যাত্রীরা ইমিগ্রেশন শেষ করে বেল্টে এসে দেখেন তখনও বেল্ট চলতেই শুরু করেনি। ছয় দিনই সব ফ্লাইটের লাগেজ বেল্টে আসতে শুরু করার জন্য সময় লেগেছে কমপক্ষে ৪০ মিনিট। শেষ হয়েছে ন্যূনতম দেড় ঘণ্টা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টানা চব্বিশ ঘণ্টা ভ্রমণের পর ফ্লাইট থেকে নেমেই বিমানবন্দরে অস্থির হয়ে পড়ে নয় বছরের শিশু আদি। বাইরে দাঁড়ানো তার দাদা-দাদি। কখন তাদের কোলে ওঠে বাসায় পৌঁছবে। ফ্লাইট থেকে নামার পর প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে তিন নম্বর বেল্টের কাছে। এত সময় অপেক্ষার পরও বেল্টে লাগেজ আসছে না। কখন আসবে লাগেজ, বার বার প্রশ্ন আদির। মা মিলি কিছুই বলতে পারেননি। এক ঘণ্টা পর বেল্টে লাগেজ আসতে শুরু করে। পরিবারটি প্রথমেই পেয়ে যায় তাদের দুটো লাগেজ। কিছুটা স্বস্তি। তৃতীয় লাগেজটির জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও এক ঘণ্টা। তখন আর কোন যাত্রী নেই ওই বেল্টের পাশে। তিনিই ছিলেন লাগেজের জন্য অপেক্ষমাণ শেষ যাত্রী। কত সময় লাগল তার? প্রশ্নের জবাবটা বেশ তীর্যক স্বরেই বের হয়ে আসে- ‘ফ্লাইট থেকে নামলাম সেই ১২টায়। এখন বাজছে দুটোর বেশি। এ জন্যই দেশে আসতে চাই না। এত দূরের জার্নি করে লাগেজের জন্য আরও আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করা কি ভাল লাগে? এ নিয়ে কথা বলতেও খারাপ লাগে। মিলির ক্ষোভ শুধু বিমানের ওপরই নয়, মিডিয়ার ওপরও। মিডিয়ার প্রতি ক্ষোভ এ জন্যই যে এ সঙ্কট নিয়ে নাকি ভাল রিপোর্টিং হয় না। তার মতোই এমন হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন লাগেজ বিড়ম্বনায় ভুগছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। তারা প্রতিদিনই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করছেন। বছরের পর বছর ধরে মিলির মতো এমন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে যাত্রীরা। তারপরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এখন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এমন চিত্র নিত্যদিনের। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে বিমান। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই গ্রাউন্ড হান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করছে বিমান। যাত্রীদের আন্তর্জাতিক বিমান-বন্দরের গ্রাউন্ড সার্ভিস যেমন হওয়া উচিত, তার ধারে কাছেও নেই। লেখালেখি হলে মাঝে মধ্যে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিদেশী কোন কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। শুরু হয় বিমানের ভেতর ও বাইরে থেকে প্রতিবাদের ঝড়। বিমানের সব শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে নানা বিষয়ে প্রচ- মতবিরোধ থাকলেও এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। যে কারণে বার বারই ভেস্তে যায় উদ্যোগ। আবারও একটা উদ্যোগ চলছে। এ সম্পর্কে বিদেশী এয়ারলাইন্স এ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ও এমিরেটস এয়ারলাইন্সের স্টেশন ম্যাানেজার জুনায়েদ বলেন, বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বাবদ চার্জ নিচ্ছে বিশ্বমানের আর সেবা দিচ্ছে সদরঘাটের। সাত ঘণ্টা ফ্লাইট জার্নি করার পর যাত্রীরা শাহজালালে লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে আরও তিন ঘণ্টা। তিনি বলেন, লাগেজ নিয়ে এ যন্ত্রণা লাঘবে বিমান খুব একটা সিরিয়াস বলে মনে হয় না। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এ সঙ্কট। সিবিএ নেতা মশিকুর রহমানের মতে, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিমান খুব সহজেই সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে। এটা এত বেগ পাওয়ার মতো কিছু নয়। বেশি নয়, প্রতি শিফটে মাত্র দুশো জনবল বৃদ্ধি আর দুশো কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট কিনলেই এ সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব। বিমানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনাও সেটা ভাল করেই জানে। তারপরও সেটা করা হচ্ছে না। বার বার দাবি জানানোর পরও জনবল বাড়াচ্ছে না। ইকুইপমেন্ট কিনছে না। কাজেই মনে হয় এ সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে বিমান কর্তৃপক্ষেরও সদিচ্ছা নেই। টানা ছয় দিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সঙ্কট যতটা জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবের দরুণ, তার চেয়ে অনেক বেশি কর্তৃপক্ষের সীমাহীন উদাসীনতা, অবহেলা, অদক্ষতা ও অরাজকতার কারণে। লাগেজ নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে সেখানে বিমানের কোন কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই-একজন ডে-লেবারকে দেখা যায় হুইল চেয়ার নিয়ে দাঁড়ানো। এছাড়া বেল্ট এরিয়ায় কাস্টমার সার্ভিসের আর কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দেখা মিলেনি। কর্মকর্তারা ওপরের তলায় তাদের কক্ষে অবস্থান করেন। যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য তারা কখনও নিচে নেমে বেল্ট এরিয়ায় আসেন না। স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারীরা তাঁদের ইচ্ছেমতোই দায়িত্ব পালন করেন। এটাই নাকি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কেন এমন হচ্ছে? জানতে চাইলে সিবিএ নেতা মশিকুর রহমান বলেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে দৈনিক ভিত্তির ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা যেভাবেই কাজ করে, অফিসাররা সেভাবে কিছুই করে না। যেমন- এয়ারপোর্ট শাখা জিএম ডিজিএম ও ম্যানেজারের ডিউটি হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার অপারেশন। তাদের সব সময় পাওয়া যায় না। বিষয়টা এমন যে, জিএম ফোনে ডিজিএমকে দায়িত্ব দিয়ে চেয়ার ছেড়ে চলে যান। ডিজিএম সে দায়িত্ব ম্যানেজারকে ফোনে জানিয়ে তিনিও চলে যান। এরপর ম্যানেজারও তার অধীস্ত জুনিয়র অফিসারকে ভাল করে ডিউটি করে সব দেখেশুনে রাখার হুকুম দিয়ে চলে যান। একজন জুনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে গুটিকয়েক কর্মচারীকেই তখন সামাল দিতে হয় বিমানবন্দরের সব ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মতো কঠিন দায়িত্ব। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতেও তারা অনেক সময় হিমশিম খায়। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যদি ফ্লাইট নামার সঙ্গেই বোর্ডিং ওই এলাকায় গিয়ে সবকিছু দেখভাল করতেন তবে দশ মিনিটের মধ্যেই বেল্ট চালু করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন বিমানবন্দরে নিয়োজিত কর্মচারীরা। এ ব্যাপারে বিমান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবাদুল্লাহ বলেন, বিমানের সীমাবদ্ধতা আছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি যেটুকু আছে সেটুকুও যদি দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ত্বরিত গতিতে কাজ করা হতো তাহলেও এত দেরি হতো না। শত শত কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট কেনার জন্য। তার দশ ভাগের এক ভাগও কেনাকাটায় ব্যয় না করে আত্মসাত করা হয়। চায়নীজ মাল কিনে ঘষামাজা করে মেড ইন আমেরিকা বলে দেখানো হয়। যে কারণে নতুন কেনা যন্ত্রপাতি দু’মাসেই অকেজো হয়ে পড়ে। আসলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে বিমানের কোন পরিকল্পনা নেই। এ নিয়ে বিমানের সাবেক এমডি কেভিনের সামনেই আমরা প্রশ্ন করেছিলাম। বিগত ৪০ বছরেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে কোন পরিকল্পনা না থাকার জবাব কেউ দিতে পারেননি। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কি ॥ একটি উড়োজাহাজের সব বহিগর্মন যাত্রীর চেক ইন করা, তাদের লাগেজ বুঝে নেয়া, যাত্রীকে উড়োজাহাজে পৌঁছে দেবার পূর্বমুহূর্তে ফের বোর্ডিং কার্ড চেক ও ডকুমেন্টেশন করা। যাত্রীর সব লাগেজ চেক ইন কাউন্টার থেকে টো-ট্রাক্টরে উড়োজাহাজের কার্গো হোলে পৌঁছে দেয়া, সেখানে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা, কার্গো পয়েন্ট থেকে আসা লাগেজ উড়োজাহাজে পৌঁছে দেয়া। সব লাগেজ ঠিকঠাকমতো ভরার পর ক্যাপ্টেন যখন দরজা-জানালা বন্ধ করে ককপিটে বসে টেকঅফের সিগনাল দেবে তখন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কর্মীরা পুশকার্টার দিয়ে ঠেলা দিয়ে উড়োজাহাজটিকে রানওয়ে পাঠাবে। তারপর টেকঅফ। বহির্গমন উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগের দায়িত্ব এ পর্যন্তই। কারোর লাগেজ খোয়া গেলে ওই যাত্রী লস এ্যান্ড ফাউন্ড শাখায় তার হারানো সংবাদ লিখে জানাবেন। যখন লাগেজ পাওয়া যাবে তখনই তাকে ডেকে এনে সসস্মানে বুঝিয়ে দেয়ার কাজ করতে হবে। যদি লাগেজ না পাওয়া যায় তাহলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যাত্রীকে ২১ দিনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স। এ ছাড়া রয়েছে লাগেজ হারানোর তাৎক্ষণিক মুহূর্তে ইন্টারিম ক্ষতিপূরণ দেয়া। বিমান এসব নিয়মের ধার ধারছে না। বিমানের ট্রাফিক বিভাগের কর্মীরা যাত্রীর চেক ইন, বোর্ডিং ডকুমেন্টেশন, যাত্রীদের জাহাজে উঠিয়ে ক্রুদের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা করে গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট শাখা (জিএসই), প্রকৌশলী শাখা ও কার্র্গো শাখা। সঙ্কট কি কৃত্রিম ॥ বর্তমানে চব্বিশ ঘণ্টায় গড়ে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ৭০ থেকে ৮০ টি উড়োজাহাজ ওঠানামা করছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কর্মীরা দাবি করছেন, যেখানে এই কাজের জন্য প্রতিশিফটে লোকবল প্রয়োজন ৩০ জন সেখানে রয়েছে মাত্র ৮জন। বছরের পর বছর ধরেই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজে সঙ্কট চলছে। এই খাতটি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে কিছু গোষ্ঠীর হীনস্বার্থে। ‘বিমান চালাতে পারবে না’-এই ধুয়া তুলে যাতে এটিকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া যায় সেজন্যই কাজ করছে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। যে সংখ্যক লোকবল ও সরঞ্জাম প্রয়োজন তার অর্ধেকও নেই। স্বল্প লোকবল ও সরঞ্জাম দিয়েই বছর বছর ধরে চলছে বিভাগটি। বর্তমানে যে জনবল রয়েছে তাদের সবাই চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। একেকজন কর্মী ২০/২৫ বছর ধরেই চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতিতে কাজ করছেন। এই খাতে বিমান বছরের শত শত কোটি টাকা আয় করছে। অথচ সেবার মান উন্নয়নে না নতুন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, না যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হচ্ছে। বিমানের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টির দিকে কখনই নজর দেননি। বিমানে এই বিভাগে বর্তমানে লোকবল রয়েছে ১২২৭ জন। বিভাগটি যথাযথভাবে চালাতে ন্যূনতম ২ হাজার ৫৪০ লোক প্রয়োজন। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগের ৯টি পুশ কার্টারের মধ্যে ৬টি অকেজো। এর মধ্যে দু’টি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া র‌্যাম্প কোচ, টু-ট্রাক্টর, হাই লিফটার, কনটেনার লোডার, প্লেট ট্রলির স্বল্পতা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রায়ই এসব সরঞ্জাম অকেজো হয়ে যায়। সময়মতো মেরামত করা হয় না। এতসব সরঞ্জামের স্বল্পতায় সময়মতো সেবা দিতে পারছে না বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগ। এসিভ্যান, গ্রাউন্ড জিপিইউ-এয়ার পাওয়ার, র‌্যাম্পকোচসহ যেসব সরঞ্জামের স্বল্পতা রয়েছে তা কাটাতে কমপক্ষে বড়জোর দু’শ’ কোটি টাকা প্রয়োজন। নতুন এমডির কোন বক্তব্য নেই ॥ এ বিষয়ে বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিঃ কেইলের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জানতে চাইলে মহাব্যবস্থাপক খান মোশাররফ হোসেনও তেমন কোন তথ্যাদি উপস্থাপন করতে পারেননি। শুধু বলেছেন, এখন থেকে ঢালাওভাবে কোন কথা বলা যাবে না। কিছু বলতে হলে এমডির অনুমতি নিয়ে বলতে হবে। জানা যায়, এমডি ও জনসংযোগ শাখা ছাড়া বিমানের অন্য কোন কর্মকর্তা যাতে মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলতে না পারে সে জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। চেয়ারম্যান যা বলেন ॥ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমান পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল জামাল উদ্দিন বলেন, শুধু গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কেন, বিমানের সব সমস্যাই সমাধানযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন শুধু সব কর্মচারী-কর্মকর্তার মানসিকতা পরিবর্তনের। সবার মনে যদি থাকে চুরি আর দুর্নীতি, তাহলে দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর শাসক কতটা সামাল দিতে পারবে? অন্য সব বিভাগের মতোই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং শাখাও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। কি ধরনের দুর্নীতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেবার মান বাড়ানোর তাগিদ দিলেই অজুহাত দেয়া হয় ‘লোকবল নেই, যন্ত্রপাতি নেই। সব অচল হয়ে আছে’। লোকবল দেয়া হলো। গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলো। পরে দেখা গেলো নিম্নমানের চায়নীজ যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। যেগুলো কদিন পর পরই অচল হচ্চে। দুর্নীতির শেষ এখানেই নয়। দেখা গেছে, চায়নীজ মাল কিনে সেটার ওপর ঘষামাজা করে মেড ইন আমেরিকা লেখা হয়েছে। সম্প্রতি পর্ষদ সভায় জিএসই বিভাগের দুর্নীতির ওপর একটা প্রেজেন্টেশন দেখে সবাই হতবাক। এমন জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে জিএসই বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়েছে। এখন সেটার তদন্ত চলছে। শাস্তি প্রক্রিয়াধীন। এই অবস্থায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা কিভাবে উন্নতি হবে। এজন্য যৌথ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে কোন পদক্ষেপ অথবা অন্য কোন কার্যকর কিছু করা যায় সেটা নির্ণয় করার জন্য একটি কনসালট্যান্ট নিয়োগের দরপত্র ডাকা হয়েছে। যেটা বিমানের জন্য লাভজনক হয় সেটাই করা হবে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং না ছাড়তে ঐক্যবদ্ধ সবাই ॥ বিমানে বর্তমানে ৪টি ইউনিয়ন আছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে চরম মতপার্থক্য থাকলেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ধরে রাখার পক্ষে সবাই নজিরবিহীন ঐক্যের পরিচয় দিচ্ছে। সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান বলেন, বিমানের একজন শ্রমিকও জীবিত থাকতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ছাড়তে দেয়া হবে না। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং লাভজনক। শুধু এটা কেন? লোকসানী ইউনিটগুলো রেখে শুধু লাভের গুড়টা বিক্রির জন্য এত উদগ্রীব কেন, সেটা সবাই জানে। দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মহলের চাপে বিমান বার বার উদ্যোগ নেয় এটা ছেড়ে দেয়ার। শ্রমিকদের জন্য বার বার হোঁচট খায়। এবারও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এবারও ঠেকানো হবে। তবে হ্যাঁ, যদি বিমানের সব ইউনিট ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে তাহলে সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে। বিমান শ্রমিকদলের সভাপতি ফিরোজ-উজ-জামান বলেন, শ্রমিকদলের কেউ জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে এটা বিদেশীদের কাছে হস্তান্তরের পক্ষে নয়। জনবল ও যন্ত্রপাতি বাড়িয়ে এটাকে মানস্মমত করা যায়। বিমান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবাদুল্লাহ বলেন, শত শত কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট কেনার জন্য। তার দশ ভাগের একভাগও কেনাকাটায় ব্যয় না করে আত্মসাত করা হয়। বিমান এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি সাইফুল্লাহ তরফদারও এটা ছাড়তে রাজি নন। জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছেড়ে দেয়া হলে বিমানের ব্যবসা তো আর বৃদ্ধি হবে না। বর্তমানে যে কয়টা ফরেন এয়ারলাইন্স বিমানের ক্লায়েন্ট, তারাই তো থাকবে। নতুন করে কেউ আর আসবে না। ব্যবসা তো এখনও যা আছে তখনও তাই থাকবে। মাঝখান দিয়ে আয়ের ওপর সমান হারে ভাগ বসাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। পাঁচ শ’ কোটি টাকার মধ্যে আড়াই শ’ কোটি নিয়ে যাবে ওরাই। কাজেই এটা হতে দেয়া যায় না। অবশ্যই বিকল্পভাবে এর মান বাড়ানোর পরিকল্পনা নিতে হবে।
×