ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আম্পায়ারদের সমর্থনে আইসিসি, আপীল করবে বিসিবি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২১ মার্চ ২০১৫

আম্পায়ারদের সমর্থনে আইসিসি, আপীল করবে বিসিবি

মোঃ মামুন রশীদ ॥ বাংলাদেশ হারেনি, হারিয়ে দেয়া হয়েছে। মেলবোর্নে খেলতে পারেনি টাইগাররা, তাদের নিয়ে খেলা হয়েছে। দেশজুড়ে ক্রিকেট ভক্ত সমর্থকদের দাবি এমনটাই। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে পরাজয়ের পেছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন দুই আম্পায়ার পাকিস্তানের আলিম দার ও ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড। ভারতের জয়ের নায়ক ছিলেন তারাই। কারণ তিনটি সিদ্ধান্ত গেছে বাংলাদেশ দলের বিরুদ্ধে যা খেলার ফলটাকেই পাল্টে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার থেকে এভাবেই সমালোচনার ঝড় চলছে। এর বিরুদ্ধে ক্রিকেটপ্রেমীরা বিক্ষোভ এবং কুশপুতুল দাহ করা হয়েছে দুই আম্পায়ারের। ক্ষোভ অব্যাহত ছিল শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশ-বিদেশের সাবেক ক্রিকেটাররাও পিছিয়ে নেয়। আর বর্তমানে আইসিসি সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী ও সাবেক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন আগামী সভাতেই বিষয়টি তোলা হবে। আর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন এই ভুল সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপীল করা হবে। তবে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইসিসি) শুক্রবার এক প্রতিক্রিয়ায় আম্পায়ারদের পক্ষেই সাফাই গেয়েছে। তারা জানিয়েছে মাঠে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তার প্রতি সবাইকে সম্মান জানাতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমালোচক পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজা। সুযোগ পেলেই কটাক্ষ করে অবমাননাকর কথা বলেন তিনি। অথচ প্রখ্যাত এ ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজাও চুপ করে থাকতে পারেননি আম্পায়ারদের নির্লজ্জ এসব সিদ্ধান্ত দেখে। এ বিষয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে টুইটারে লেখেন, ‘দারুণ দেখিয়েছ আইসিসি-ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল। নিশ্চিত তোমরা পুরোপুরি বিক্রি হয়ে গেলে।’ বিশেষ করে পেসার রুবেল হোসেনের বলে সেঞ্চুরিয়ান রোহিত শর্মা ব্যক্তিগত ৯০ রানে ক্যাচ আউট হওয়ার পর নো বল ঘোষণাটি নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের ক্রিকেটবোদ্ধাদের। কোনভাবেই নো বল ডাকার মতো ‘বিমার’ ছিল না সেটি, বলটি ছিল সাধারণ ফুলটস। এ বিষয়ে কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার শেন ওয়ার্ন টুইটারে লেখেন, ‘আলিম দারের মতো আম্পায়ারের কাছ থেকে এটা হতাশাজনক সিদ্ধান্ত। যথেষ্ট উঁচুতে ছিল না বলটি।’ এমনকি পিছিয়ে থাকেননি ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী ও ভিভিএস লক্ষণও। সৌরভ লিখেছেন, ‘বলের উচ্চতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে সেটা তৃতীয় আম্পায়ারকে দেয়া উচিত।’ আর লক্ষণ লেখেন, ‘গোল্ডের কাছ থেকে বাজে সিদ্ধান্ত এলো। এটা কোনভাবেই নো বল হতে পারে না। ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছেন রোহিত।’ ওই ভুলটাই ম্যাচের ফল নির্ধারণী হতে পারে বলে আভাস দিয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে ক্রিকইনফো লিখেছিল, ‘উচ্চতার জন্য নো বল দেয়া হলো কিন্তু তাই ছিল কী? ম্যাচের ফল নির্ধারণী সিদ্ধান্ত হতে পারে এটি।’ সত্যিই তাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে বাংলাদেশ দল বার বার সঠিক সিদ্ধান্তটা বিপরীত হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে। এ কারণেই সাবেক অসি অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেন, ‘যেভাবে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত দেখলাম তা অভাবনীয়। এমনটা মেনে নেয়া খুবই কঠিন। এসব বাজে সিদ্ধান্তের কারণেই আজ হারল বাংলাদেশ। পুরো আসরে দলটি দুর্দান্ত খেলেছে। আমার মনে হয় আবারও এ ম্যাচটি হলে ভারতই হারবে।’ এরপরও কী বিসিবি চুপ করে থাকবে? দুর্দান্ত খেলেছিল বাংলাদেশ পুরো আসরেই। কিন্তু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাজেভাবে হেরে গেছে টাইগাররা। এ কারণে আইসিসির কাছে অভিযোগ দাখিলের পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিসিবি। এ বিষয়ে বিসিবি সভাপতি পাপন বলেন, ‘এর বিরুদ্ধে আপীল তো হবেই। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে একটি ভুল সিদ্ধান্ত পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। সেই জায়গায় একাধিক সিদ্ধান্ত আমাদের বিপক্ষে গেছে যা পৃথিবী দেখেছে।’ বর্তমান আইসিসি প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামালও বিসিবির সাবেক সভাপতি। তিনিও মেনে নিতে পারেননি। তাই আইসিসির সভাপতি হলেও আম্পায়ারিং নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। বলেছেন, ‘কোন মান ছিল না আম্পায়ারিংয়ের। মনে হচ্ছিল তারা সব ঠিকঠাক করেই মাঠে নেমেছেন। আইসিসির সদস্য হিসেবে আমরা সরাসরি আইসিসির বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারব না। এখন আইসিসির দায়িত্ব হবে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে বের করা যে এখানে কোন বিতর্কিত বিষয় আছে কিনা। অবশ্যই আইসিসি একটা পদক্ষেপ নেবে।’ এতকিছুর পরও ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডও (বিসিসিআই) এখন এসব আমলে নিতে চাইছে না। বিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত সেক্রেটারি অনুরাগ ঠাকুরের কণ্ঠে তেমন আভাসই পাওয়া গেল। তিনি প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামালের মন্তব্য নিয়ে বলেন, ‘তার (কামাল) উচিত বিষয়টি আইসিসিতে উত্থাপন করা আগামী সভার সময়। আমার মনে হয় এখন আমাদের এসব নিয়ে পড়ে থাকা ঠিক হবে না। সামনে এগোতে হবে এবং সেমিফাইনাল নিয়ে ভাবতে হবে। সে সব নিয়েই আলোচনা করা উচিত হবে।’ আর আইসিসিও ম্যাচের দুই আম্পায়ার আলিম দার ও গোল্ডের পক্ষে কথা বলছে। কারণ আইসিসির এলিট প্যানেল ভুক্ত অভিজ্ঞ আম্পায়ার এ দু’জন। আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন তাদের পক্ষেই সুর ধরলেন। তিনি আইসিসি সভাপতি মোস্তফা কামাল আম্পায়ারিং নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আইসিসি বিশেষভাবে মোস্তফা কামালের মন্তব্য বিশেষভাবে বিবেচনায় এনেছে। তার এমন মন্তব্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন। কিন্তু আইসিসি ম্যাচ কর্মকর্তাদের সমালোচনা করার সময় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে আরেকটু বিবেচনা করে কথা বলা প্রয়োজন ছিল। নো বলের সিদ্ধান্তটা সবসময়ই ৫০/৫০। ক্রিকেটের বড় বিষয় হচ্ছে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং অবশ্যই সম্মান দিতে হবে।’ এরপর তিনি দাবি করেন শক্ত কোন প্রমাণ কিংবা তথ্য না থাকলে কোন আম্পায়ারকেই এভাবে দোষারোপ করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘আম্পায়ারদের মনে কোন অভিলাষ কিংবা নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য না দেয়ার কোন বিষয় ঘটেছে এমন ধারণা ভিত্তিহীন। আর শক্ত কোন তথ্যাদি না থাকলে এসব অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করা হবে।’ ঢাবিতে দিনভর বিক্ষোভ ॥ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়ার ঘটনায় এখনও থামেনি ক্ষোভের আগুন। শুক্রবার সারাদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল টাইগার প্রেমিদের মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল। এ সব সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় বিশ্বকাপে ভাল খেলায় দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে টাইগারদের গণসংবর্ধনা দেয়া হবে। এছাড়া পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আইসিসির বর্তমান সভাপতি আহম মোস্তফা কামালকেও পদত্যাগের আহ্বান জানান তারা। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যানস ইউনিটি (বিসিএফইউ) নামের টাইগারভক্ত একটি সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যোগ দেয়। মানববন্ধন শেষে টিএসসি থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শাহবাগ গিয়ে পুনরায় টিএসসি এসে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর ঘুরে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ ক্রিকেট প্রেমীরা সেøাগান দেন, ‘আইসিসি’র সিদ্ধান্ত মানি নাÑ মানবে না, আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তÑ মানি না মানবো না, আম্পায়ারের দুই গালেÑ জুতা মারো তালে তালে, বাংলাদেশ হারেনিÑ হেরেছে ক্রিকেট’। মিছিলে যোগ দেয় গণজাগরণ মঞ্চের নেতা কর্মীরা। মিছিল শেষে দুই আম্পায়ারের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। সমাবেশ বিক্ষুব্ধ ক্রিকেটপ্রেমীরা বলেন, টাইগাররা কৃতিত্বের সঙ্গে খেলার পরেও আম্পায়ারদের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের কারণে তারা জিততে পারেনি। তাই আগামী রবিবার বিমানবন্দরে গিয়ে আমরা স্বশরীরে তাদেরকে সংবর্ধনা দেব। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওসিকুল আজাদ বলেন, সুস্পষ্ট নির্জজ্জ পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে ভারত জিতেছে। আমরা আশা করছি অবিলম্বে এ ঘটনার প্রতিবাদে আইসিসির সভাপতি পদত্যাগ করবেন। এ সময় তিনি অভিযুক্ত দুই আম্পায়ার আলিমদার ও গোল্ডকে আজীবন নিষিদ্ধেরও দাবি জানান। এছাড়া সমাবেশে বক্তব্য দেন, বিসিএফইউয়ের সভাপতি শেখ ইরফান, সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীবন সুদীপ এবং সদস্য শোভন ইসলাম, রাজ বাশার প্রমুখ। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে একই ঘটনার প্রতিবাদে মশাল মিছিল করে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। মিছিলটি শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঘুরে আবার শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় তারা আইসিসি এবং ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে সংশ্লিষ্ট আম্পায়ারদের বিচারের দাবি জানান।
×