ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রয়োজনের কাছে হেরেছে বিএনপি জামায়াত ॥ পরাজিত হরতাল

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২২ মার্চ ২০১৫

প্রয়োজনের কাছে হেরেছে বিএনপি জামায়াত ॥ পরাজিত হরতাল

রশিদ মামুন ॥ আকছির, বয়স ৪৫ এর আশপাশে। ঢাকার রাস্তায় গত কুড়ি বছর ধরে রিক্সার প্যাডেল ঘুরান। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামে যান কিন্তু তা নিতান্তই স্বল্প সময়ের জন্য। এছাড়া প্রায় প্রতিটি দিনই তিনি রাস্তায় নামেন। ঢাকার অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক সবটাই তাঁর চেনা। এই রাস্তা গত কুড়ি বছরে কোন্ দিন কী আচরণ করেছে আকছির এক নিশ্বাসে তা বলে যান। নিজে থেকেই প্রশ্ন করেন, মামা শুইনা বাইর হই হরতাল কিন্তু এ কেমন হরতাল রাস্তার জ্যাম ছোটে না। গত কয়েক দিন ধইরাই বুইঝা পারতেছি না কোন্ দিন হরতাল এর কোন্ দিন হরতাল না। আগে হরতালে যে তেঁজ ছিল এখন তা দেখি না। কারা ডাকে, কই বইয়া ডাকে আর কারা পালন করে তাগোরেও দেখি না। তাইলে মামা এই দিনডার নাম হরতাল দিছে ক্যান। যত্তসব ফাইজলামি না জ্যামজুমের মধ্যে আপনে আইয়া কইলেন হরতাল। হেইডা কোন কিছু হয় বলেন? সত্যিই তো? হয়! এমনটা হওয়া কী সম্ভব? রিক্সার প্যাডেলের সঙ্গে আকছিরের মুখ চলে, হ্যারা ভাবছে ডাকছি তো ডাকছি হরতাল। আর নড়মু না। কিন্তু মামা আমরা খামু কি হ্যাগো মাথা চাবাইয়া। নিজস্ব অবস্থান থেকে খিস্তি করে থেমে যান আকছির। টানা ৭৬ দিনের অবরোধ ও হরতালে শব্দ দুটির অর্থ বদলে গেছে। অধিকার আদায়ের এই কর্মসূচীটির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই মানুষের প্রয়োজনের কাছে হেরে গেছে হরতাল। শুধু দেশের সাধারণ মানুষের কাছেই নয়, বিএনপি-জামায়াত নিজেদের কাছেও হেরে গেছে। তাদের সকল প্রতিষ্ঠানে হরতালের দিন স্বাভাবিক কর্মকা- চলছে। জানা গেছে, হরতাল-অবরোধে পুরোপুরি সচল রয়েছে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সকল প্রতিষ্ঠান। বিএনপি নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরতাল চলাকালে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দলের ব্যবসায়ী নেতাদের কর্পোরেট অফিস, বাণিজ্যিক অফিস ও শিল্প-কারখানা খোলা থাকছে। সবখানে স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে। কোন হরতালেই দলটির শীর্ষ নেতাদের কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়নি। উৎপাদনসহ অন্যান্য দাফতরিক কাজ হয়েছে পুরোদমে। প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হারুনুর রশীদ খান মুন্নু, বিএনপির কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, চেয়ারপার্সনের আরেক উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের সকল নেতাদের প্রতিষ্ঠানই হরতালে খোলা থাকছে। হারুনুর রশীদ খান মুন্নুর মালিকানাধীন ঢাকার ধামরাইয়ে মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হরতালের কোন প্রভাব পড়েনি। উৎপাদন বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত কোন হরতালে বন্ধ হয়নি মুন্নু সিরামিকস। হরতালের দিনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই এ প্রতিষ্ঠান চলে। গাজীপুরে জয়নুল আবদিন ফারুকের মালিকানাধীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বিজি কানেকশনও হরতালে খোলা রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক এমপি জিএম সিরাজসহ প্রথম ও মধ্যসারির আরও বহু নেতার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন চালু রয়েছে। কল্যাণপুরে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা এসএ খালেকের সিএনজি স্টেশন ‘খালেক সার্ভিস স্টেশন’ সচল। হরতাল-অবরোধে এ স্টেশন বন্ধ রাখার জন্য মালিকপক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিনা, প্রশ্ন করা হলে এক কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে মালিকের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি। বিএনপির বগুড়ার সাবেক এমপি জিএম সিরাজের এসআর ট্রাভেলস, বিএনপির সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ কফিল উদ্দিনের হানিফ পরিবহন হরতাল-অবরোধের গত এক মাসে একদিনও বন্ধ থাকেনি। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাকারিয়া তাহেরের রাজধানীর মহাখালী লিংক রোডে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর সঙ্গে লিংক রোডে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিরও অংশীদার তিনি। বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হরতাল-অবরোধের মধ্যেও খোলা থাকে। এছাড়া হরতালে-অবরোধে রাজধানীতেই বিএনপি-জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের বাস চলাচল করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ঢাকা পরিবহনের মালিক। কিন্তু হরতাল-অবরোধেও ঢাকা পরিবহনের বাস রাজধানীতে চলাচল করছে। আর উইনার পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম কাজল। এই বাসটিও আজিমপুর, পান্থপথ, বাড্ডা, রামপুরা রোডে চলাচল করছে। অনাবিল, ছালছাবিল, বৈশাখী ও লাব্বাইক পরিবহনের মালিকরাও বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতা। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ঢাকা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন। এই ব্যাংকটিও অন্যান্য ব্যাংকের মতো হরতালের দিনে খোলা থাকছে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী বীমাসহ জামায়াতের শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার কোনটিতেই হরতাল অবরোধ কোন প্রভাব ফেলে না। দাবি আদায়ে সারাবিশ্বে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে হরতালের ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু হরতালের নামে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আর আতঙ্ক সৃষ্টি ছাড়া কিছু করতে পারেনি। পেট্রোল বোমায় ঝলসানো মানুষের আর্তনাদও হরতাল আহ্বানকারীদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। যদিও হরতাল আহ্বানকারীরা বলছেন এই আন্দোলনে জনসমর্থনই তাদের সব থেকে বড় প্রাপ্তি। দ্য ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (১৯৪৮), ইন্টারন্যাশনাল কভোনেন্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (১৯৭৬) ও ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (১৯৫০) মতে, মৌলিক অধিকার পালনে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে মৌলিক অধিকার পালন করতে অন্যের অধিকার খর্ব করা যাবে না। শুধু আন্তর্জাতিকভাবেই নয় দেশেও জোরপূর্বক হরতাল পালনে কাউকে বাধ্য না করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। উচ্চ আদালতে ১৯৯৯ সালে হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এর পরের বছর ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর উচ্চ আদালত এক রায়ে বলে- কোন প্রকার ভয়ভীতি না দেখিয়ে হরতাল ডাকা একটি বৈধ কর্মকা- এবং সেটা প্রতিবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) (এ) সংরক্ষিত। এখানে ভয়ভীতি না দেখিয়ে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আদালত আরও বলেন, যদি হরতাল আহ্বান এর সঙ্গে ভয়ভীতি প্রদর্শন জড়িত থাকে বা হরতাল পালনে কাউকে কোনভাবে বাধ্য করা হয়, তাহলে হরতাল ডাকা অবৈধ হবে। কারণ সেটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। অতীতে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন হরতাল আহ্বান না করা হলেও এখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালতের প্রত্যেকটি রায়ের পরই জামায়াত হরতাল আহ্বান করেছে। বিএনপি পেছনে থেকে এই হরতালকে সফল করতে কাজ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হরতাল সফল করার অন্যতম উপায় হিসেবে মানুষের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা করছে। কিন্তু টানা ৭৬ দিন মানুষ হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে কিভাবে তাদের পেট চলবে, তা ভাবছে না হরতালকারীরা। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির মতে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে হরতাল হয়েছে তিন দিন, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সাত দিন, ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৭ দিন এবং ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪৬ দিন। বিগত ২০১৪ সালে বিএনপি তিনদিন আর জামায়াত ১১ দিন হরতাল ডেকেছে। জামায়াতের সব হরতালই ছিল যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে। আর ২০১৫ সালে এসে ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতার হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। চলমান হরতাল অবরোধের প্রথম সাত দিন এবং সব শেষ সাত দিনের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় এখন সারাদেশের কোথাও হরতাল-অবরোধের মতো পরিস্থিতি নেই। মাঝে মধ্যে দেশের কোথাও কোথাও পেট্রোলবোমা হামলা হচ্ছে, যা মানুষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। তবে তা মানুষকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারছে না। কেবলমাত্র দেশের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকায় বন্ধ রয়েছে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র এবং শনিবার স্কুলগুলো ক্লাস এবং পরীক্ষা নিচ্ছে। যথারীতি মাধ্যমিক পরীক্ষাও শেষের পথে। হরতাল না থাকলেও এই দুই দিনের অররোধ তোলেনি বিএনপি। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে যথারীতি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর কমিশনের সিদ্ধান্তের পর দেশের সরকারী এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরে স্বাভাবিক পণ্য পরিবহনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি হরতাল। দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থার নিরসন হয়েছে। হরতাল অবরোধের কারণে ঢাকার বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। তবে কারসাজি করে গরুর মাংসের দাম কিছুটা বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। মাছ-সবজি-মুরগির দাম বছরের অন্য সময়ের মতোই স্বাভাবিক রয়েছে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য অন্য পণ্যের ওপর হরতালের কোন প্রভাব পড়েনি। কাঁচাবাজারের সরবরাহ প্রথম কিছুটা কম থাকলেও এখন তা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। যাত্রী পরিবহনে সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে এখন বিলাসবহুল এসি কোচও রাস্তায় নেমে এসেছে। ঢাকার রাস্তায় বিলাসবহুল সকল গাড়ি স্বাভাবিকভাবেই চলছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই দেশের কোথাও কোথাও পেট্রোলবোমা হামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। নাশকতার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে হরতাল আহ্বানকারীরা। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা বলেছেন, সরকার নির্বাচন দিলেই কেবল দেশের সঙ্কটময় পরিবেশের উন্নতি হবে। সম্প্রতি দেয়া লিখিত বক্তৃতার নবম পৃষ্ঠার তিন নম্বর প্যারার দ্বিতীয় লাইনে বেগম জিয়া বলেন, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সঙ্কটের সুরাহা হবে।’ একই পৃষ্ঠায় পরের প্যারাতে তিনি বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা যদি কোন আলোচনা করতে না চায় তাহলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এককভাবে তাদের ওপরেই বর্তাবে। তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে, তা তারা একতরফাভাবে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই দেশে সঙ্কটের অবসান ঘটবে।’ যদিও বক্তৃতায় বেগম জিয়া চলমান নাশকতায় তাঁর বা তাঁর দলের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়ে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের বাণী ৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেই জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতালে কাল থেকে চলবে রিক্সা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবেÑ শুধু... সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গবর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।’ উপমহাদেশে হরতালের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯১৯ সালে রাওলাট আইন প্রবর্তিত হলে গান্ধী ওই আইনকে ‘শয়তানের প্রতিভূ’ অভিহিত করে ১ এপ্রিল ওই বিল বাতিলের দাবিতে সমগ্র ভারতে হরতাল বা ধর্মঘট আহ্বান করেন, যা ভারতবর্ষের প্রথম হরতাল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। যদিও গান্ধী প্রবর্তিত অহিংস হরতাল সহিংস হয়ে উঠলে তিনি ওই কর্মসূচী পরিত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো অবস্থায় গরিবের কথা ভাবতে ভুল করেননি বঙ্গবন্ধু। সাধারণের যাতে সমস্যা না হয় এজন্য বঙ্গবন্ধু কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়েছিলেন। অহিংস হরতাল সহিংস হয়ে উঠলে ওই কর্মসূচী পরিত্যাগ করেন গান্ধী। কিন্তু এখন নির্বিচারে সেই গরিবই হরতাল অবরোধের সব থেকে বড় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। হরতাল অবরোধে এখন পর্যন্ত আগুনে পুড়ে নিহত বা দগ্ধদের প্রায় সকলেই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর। গত ৭৬ দিনের হরতাল অবরোধে নিহত হয়েছেন ১৩২ জন। এদের মধ্যে হরতাল আহ্বানকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৭ জন। বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৭ জন আর ১৯ জনের মৃত্যুর কারণে সংঘর্ষ এবং সড়ক দুর্ঘটনা। হরতাল অবরোধে এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এছাড়া ৭৩০টি যানবহনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে আর ভাংচুর হয়েছে ৬৬০টি যানবহন এত লোক হতাহতের পরও বিএনপি আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। উপরন্তু শনিবারও আবার নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হরতাল দিয়েছে। শনিবার দুপুরের দিকে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলুর নামে পাঠানো বিবৃতিতে হরতাল আহ্বান করা হয়। বিএনপি একদিকে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে হরতালের সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে রেখেছে। গত সাত দিনের হরতাল পরিস্থিতিতে দেখা যায় ২০ মার্চ ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলায় একটি ট্রাকে ছুড়ে মারা পেট্রোলবোমায় পাঁচজন দগ্ধ হয়েছেন। এছাড়া ১৮ মার্চ রাতে চাঁদপুরের সদর উপজেলার চন্দ্রা এবং রঘুনাথপুরে দুটি পণ্যবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা হামলা হয়েছে। এতে চন্দ্রায় জাহাঙ্গির হোসেন (৪০) নামে এক ট্রাকচালক নিহত হন। গুরুতর দগ্ধ হন আরও পাঁচজন। অন্য পাঁচ দিন কিছু ঘটেনি। প্রথম সাত দিনের ঘটনাপ্রবাহ বলছেÑ সারাদেশেই বিক্ষিপ্তভাবে হরতাল অবরোধের মাধ্যমে নৈরাজ্যকর একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম সাত দিনে পেট্রোলবোমা হামলায় নিহত হন ১৩ জন। আহত হন পাঁচ শতাধিক। এ সময় ১৪৫টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয় আর ভাংচুর হয় ৪৫০টি পরিবহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, দেশের সবখানে সব ধরনের পরিবহন চলছে। যাত্রী পরিবহন একেবারে স্বাভাবিক রয়েছে। শুধু দিনে নয়, রাতেও পরিবহন চলছে। কোথাও কোন বাঁধা বা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে হরতাল অবরোধের মধ্যে তাদের বন্দরের পণ্য পরিবহনে কোন সমস্যা হচ্ছে না। আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে সকল পণ্য খালাস হচ্ছে। বিদেশী জাহাজও বন্দরে আসছে এবং বন্দর ত্যাগ করছে। দেশের সিংহভাগ আমদানি রফতানি হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, এখন গড়ে আমাদের প্রতিদিন আড়াই হাজার কন্টেনার ডেলিভারি করছি। সাধারণ দিনেও আমরা একই পরিমাণ কন্টেনার ডেলিভারি করি। বন্দরের কন্টেনার ডেলিভারিতে প্রথম কয়েক দিন একটু সমস্যা হলেও তা অনেক দিন আগেই কেটে গেছে বলে জানান তিনি। এখন বাধাহীনভাবেই আমদানি রফতানি হচ্ছে।
×