রাজন ভট্টাচার্য ॥ স্বামী হাসিবুর রহমান ওরফে হাসিবকে হারিয়ে গৃহবধূ ইয়াসমীন বিজলী এখন দিশেহারা। তাঁর কোলে চার মাসের শিশু। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার পাচগাছি থেকে এসে বগুড়া শহরের চারমাথা এলাকায় থাকতেন। সাজানো গোছানো সুখী সংসার ছিল তাঁর। কিন্তু তা টেকেনি। পাষ-রা নিমিষেই তছনছ করে দিয়েছে সবকিছু। সাত ফেব্রুয়ারি রাতে ট্রাকে সবজি নিয়ে যাওয়ার পথে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান হাসিব। নিরুপায় ইয়াসমিন আশ্রয় নেন শেওলাগাতি গ্রামের বাবার বাড়িতে। বাবা ইয়াসিন আলী কাজ করে বই বাঁধানোর। তাঁর নিজের সংসারের চাকা এমনিতেই অচল। পত্রিকায় তাঁর শিশুর ছবি ছাপা হওয়ায় দুইজন পাঁচ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করেছিলেন। পিতৃহারা ছোট শিশুকে নিয়ে কোথায় যাবেন বিজলী? স্বামীহারা এই মানুষটির আর্তনাদ আর গগনবিদারী চিৎকার নাশকতাকারীদের এপথ থেকে হয়ত ফেরাতে পারবে না। হয়ত হাসতে হাসতে ফের মানুষ হত্যার সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে নাশকতাকারীরা।
টানা দেড় মাসের রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে পেট্রোলবোমা হামলাসহ আগুনে পুড়িয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৫ পরিবহন শ্রমিক। ঢাকা মেডিক্যালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন প্রায় শতাধিক চালকসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। আহত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় চার শতাধিক পরিবহন শ্রমিক। আর্থিক সহযোগিতার জন্য নিহতদের মধ্যে ৩২ জনের তালিকা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। পেট্রোলবোমা ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে দুই হাজার যানবাহন। কিন্তু কেন এই বর্বর হত্যা, নৃশংসতা। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে এত মৃত্যু আর নৃশংসতা কখনও বাংলাদেশে এর আগে হয়নি। যা সবাইকে হতবাক করে তুলেছে।
কতদিন চলবে এই সহিংসতা। কবে থামবে স্বজনহারা মানুষের কান্না? এ প্রশ্নের জবাব হয়ত নেই। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কষ্টের মাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস আর যন্ত্রণা। নীরব দহন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে রাত-দিন। তবুও স্বামী ও পিতৃহারাদের রয়েছে হাজারো প্রশ্ন। কে দেবে তাদের প্রশ্নের জবাব। সান্ত¡না যোগাতেও কেউ পাশে নেই। ভবিষ্যত অনিশ্চিত। অসহায় এই পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। হয়ত হাজারো যন্ত্রণা আর দুর্দশার মধ্যেই তাদের চলবে হবে। প্রশ্ন হলো বর্বর এই হত্যাকা-ের দায় কে নেবে? কোন অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছে? জবাব হয়ত কোনদিনই মিলবে না। হত্যাকারীরাও রয়ে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নির্দেশদাতারাই হয়ত একদিন রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেবেন!
সংসারের চাকা সচল রাখতেই রাস্তায় নেমেছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা। প্রতিদিনের রোজগারে চলবে সংসার। সবার মুখে হাসি থাকবে। স্কুলে যাবে সন্তান। বড় হবে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে কষ্ট ঘোচাবে। হঠাৎ করেই এসব পরিবারের মাঝে নেমে এলো নিকষ অন্ধকার। ঘোর অমাবস্যা। অনাকাক্সিক্ষত আকস্মিক ঝড়ে সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। পাল্টে যায় জীবনের গতিপথ, যা পুরোপুরি এসব পরিবারকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলনের সর্বশেষ বলি হলেন ফেনীর ট্রাকচালকসহ পাঁচজন। অবরোধের ৭৪তম দিন ছিল শুক্রবার। এদিন ফেনীর দাগনভূঞায় পেট্রোলবোমা হামলায় তারা দগ্ধ হয়েছেন। আহতদের কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন সবাই। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক কর্মজীবনে আর ফিরতে পারবেন কিনা তা অনিশ্চিত। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন পরিণতিতে পরিবারগুলো আজ অসহায়। কষ্ট আর দুঃস্বপ্নে কাটছে রাত দিন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জনকণ্ঠ’কে বলেন, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে শনিবার পর্যন্ত পরিবহনে পেট্রোল বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগে ৩৫ চালক ও শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯৬। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে আহত হয়ে ৩৭০ পরিবহন শ্রমিক বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আহত ও নিহত পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক সহযোগিতা দেয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দাবি সবাই যেন চলতে পারে এরকম আর্থিক সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যাবে। তিনি জানান, নিহত ৩২ শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তালিকা পাঠানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় আগের চেয়ে নাশকতা কমে এলেও সুযোগ বুঝে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপিসহ জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসীরা। তাদের বিশেষ লক্ষ্য পরিবহন সেক্টর। এই সেক্টরকে অকেজো করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সফলতা নিজেদের ঘরে তুলতে চায় ২০ দল। কিন্তু দেশের ৬৪ জেলায় যাত্রীবাহী বাস চলাচল স্বাভাবিক। পণ্য পরিবহন চলছে। সচল বন্দর। বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়ীরাও বসে নেই। তাদের পরিবহন, গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সবই স্বাভাবিক।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার শ্রীরামপুর গ্রামের ট্রাকচালক আইয়ূব হোসেনের ছেলে ইমরান পড়াশোনার পাশাপাশি ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঝিনাইদহ থেকে ট্রাক নিয়ে দিনাজপুর যাওয়ার পথে বগুড়ার বেলাইলে পেট্রোলবোমার শিকার হন ইমরান। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ইমরানের ভাই রকি হাসান বলেন, পরিবারে অচলাবস্থা বিরাজ করতে। কেউ কোন সহযোগিতা করেনি। প্রায় প্রতিদিনই উপোস থাকতে হচ্ছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বন্তেঘরি গ্রামের পান ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলামের উপার্জনে তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার চলত। স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাকে পেট্রোলবোমা হামলায় আহত হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। তাঁর ছোট ভাই ফারুক হোসেন জানান, সংসারে উপার্জন বন্ধ হওয়ায় সবাইকে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। বলতে গেলে মানবেতর জীবন যাপন করছে পরিবারটি। অথচ ঘাতকদের গ্রেফতার কিংবা এই হত্যাকা-ের বিচার হবে কিনা তা অনিশ্চিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে ৩ মার্চ পেট্রোলবোমায় নিহত হন কাভার্ডভ্যান চালক এমরান হোসেন (৩০)। তাঁর পরিবারে চলছে মাতম। এমন নৃশংস মৃত্যুর খবর শুনে স্ত্রী শাহনাজ বেগমের যেন কান্না থামছেই না। শোকে স্তব্ধ তিনি। আদরের সন্তানের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ বাবা আবদুল মান্নান ও মা ফরিদা বেগম। এমরান ছয় বছরের মেয়ে সিনথিয়া ও চার মাসের ছেলে আমানকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। এখন সবই গেল। কিভাবে চলবে সংসারের চাকা?
এখানেই শেষ নয়। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের পৈশাচিক তা-বে অসংখ্য শিশু জন্মের পর পিতার মুখটুকুও দেখতে পাবে না। সারা জীবনের জন্য প্রিয় ‘বাবা’ ডাকটিও অনেকের জন্য থেমে গেছে। যেমনটি হয়েছে সারের পরিবারের ক্ষেত্রে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে টানা ৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হন তিনি। সাবেরের অকাল মৃত্যুতে তার দুই ছেলে ও স্ত্রীর সংসার চালানো নিয়ে গভীর শঙ্কায় পড়েছেন বৃদ্ধা মা তামান্না বেগম। হাসপাতালে বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘এখন আমি কিভাবে তার সংসার চালাব। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি রে বাপ- তুই কোথায় চলে গেলি।’ একইভাবে কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন সাবেরের স্ত্রী।
নিহত সাবের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভা-ার দমদমা এলাকার তোফায়েল আহমেদের ছেলে। সাবেরের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলের বয়স ৪ বছর। আর ছোট মেয়ের জন্ম হয় তার বাবা দগ্ধ হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। ৪ মার্চ রাতে হাটাহাজারী থানার চারিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে মির্জাপুর ইউনিয়নের এনায়েতপুরের কালীবাড়ি যাওয়ার পথে চারিয়া মাদ্রাসা এলাকায় অবরোধ সমর্থকদের পেট্রোলবোমার শিকার হয় সাবেরের অটোরিকশা। এতে সাবের ও অটোরিকশা যাত্রী রণজিত নাথ দু’জনেই গুরুতর দগ্ধ হন। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিনই মারা যান রণজিত। শরীরের ৪৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন অটোরিকশা চালক সাবের।
সড়ক পরিবহন সমিতির সহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জনকণ্ঠ’কে বলেন, স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল সহিংসতাকারীদের কানে পৌঁছে না। মানুষ হত্যা করে কার স্বার্থে এই সহিংস আন্দোলনÑ এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, প্রায় আড়াই মাসে দুই হাজার পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার গাড়ি আগুন ও পেট্রোলবোমা দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাংচুরের শিকার হয়েছে বাকি এক হাজার যানবাহন। আহত ও নিহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আহত শ্রমিকদের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু হয়েছে। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন কয়েক পরিবহন শ্রমিকের হাতে প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দিয়েছেন। নিহতের তালিকা করে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, নাশকতায় ক্ষতি ৮২৩ গাড়ির তালিকা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এর মধ্যে ৪৭৪ গাড়ির ক্ষতিপূরণ মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।