ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হাণ্ডিয়ালের ইতিকথা

নানা দর্শনীয় স্থাপনা, বাঙালীর ইতিহাস সংস্কৃতির অনুষঙ্গ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২২ মার্চ ২০১৫

নানা দর্শনীয় স্থাপনা, বাঙালীর ইতিহাস সংস্কৃতির অনুষঙ্গ

সমুদ্র হক ॥ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে পাবনার চাটমোহরের চৌধুরী বাড়ির রয়েছে একটা নিবিড় সম্পর্ক। সাহিত্যের দিকপাল প্রমথ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে কবিগুরুর পরিবারের আত্মীয়তার একটা সম্পর্ক আছে, এমনটি জানা যায়। তবে এই ফিচারের বিষয় চাটমোহরের নানা স্থাপনা নিয়ে। যেখানে বাঙালী সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাঙালীর ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ের চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের সম্ভার রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তো নয়ই, বাঙালীর মননে যেখানে বাস সেখানে চাটমোহর লিখতে গিয়ে একটু টেনে আনা। সেই চাটমোহরের বড় এক কীর্তি হান্ডিয়াল। নাম অবশ্য হান্ডিয়াল নয়। কিভাবে যে হান্ডিয়াল হলো তাও এক গল্প। চলনবিল পাড়ের এই ইউনিয়নের নাম হাঁড়িয়াল। বর্তমানের তাড়াশ উপজেলা সদরের কাছেই। তাড়াশ নামটি হয়েছে ত্রাস থেকে। ত্রাসের জ্বালায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে হাঁড়িয়ালে থানা স্থাপন করে। চন্দ্রবিন্দু সংযোগে ইংরেজদের কণ্ঠে হাঁড়িয়াল উচ্চারণ হান্ডিয়াল হয়ে যায়। সেই থেকে হান্ডিয়ালই রয়ে গেছে। তবে থানা সদর (উপজেলা) হয়েছে হান্ডিয়াল থেকে কিছুটা দূরে চাটমোহর। এই হান্ডিয়াল লালন করছে বুড়া পীরের মাজার, শাহীপথ, জগন্নাথের মন্দির, গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ মন্দির, দোল মঞ্চ, শেঠের বাংলোসহ নানা স্থাপত্য। দর্শনীয় এসব স্থাপনার সঙ্গে বিলপাড়ের নিভৃত প্রান্তরে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ছুঁয়ে দেয়। শেঠের বাংলো স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসঘাতক সহচর জগৎশেঠের। কাশিমবাজার কুঠির পর এই বাংলোতেই জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ঘষেটি বেগম, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর আলী খাঁ, ওয়াটসনদের সঙ্গে অনেক বৈঠক করেছেন। আবার এই হান্ডিয়ালেই তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রশাসনিক কার্যক্রমের একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত ছিলেন। শাহী সুবেদারের অধীনে ছিল মুঘলদের পাঁচ হাজার সেনা, ছিল সেনানিবাস। তারও আগে পাঠানদের রাজত্বকালে সেই সময়ের প্রমত্তা করতোয়া নদী তীরের এই এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নত বন্দর ছিল। যেখানে মুর্শিদাবাদ থেকে বজরা নৌকা রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছার আগে কিছুটা সময় হান্ডিয়ালে অবস্থান করত। এতটাই বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল যে হান্ডিয়াল বাজারের এক দালানের ছাদে উঠে সব দালান ঘোরা যেত। কোম্পানি আমলে উন্নত বন্দর হান্ডিয়ালে গড়ে ওঠে রেশম ও তাঁতের কাপড়ের বেচা কেনার কুঠি। ওই সময়ে ভারতবর্ষে যত রেশম উৎপন্ন হতো, তার চার ভাগের তিন ভাগই মিলত হান্ডিয়াল বাজারে। এই হান্ডিয়াল থেকেই ব্রিটিশরা রেশম ও তুলা নিয়ে যেত। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় হান্ডিয়ালের তাঁত বর্তমানে বৃহত্তর পাবনার তাঁত শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। চাটমোহর ও সংলগ্ন হান্ডিয়াল এলাকায় বিশাল আয়তনের যে ৫০টি দীঘি আছে তা প্রকৃতির নিসর্গ। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে এই দীঘিগুলোর জল মৃদু থৈথৈ করে প্রকৃতির ধ্রুপদী মাত্রা এনে দেয়। মনে হবে চাঁদ নাচছে, তারা নাচছে ওই দীঘির জলে। এমন নিসর্গ অবগাহনে সেখানে কোন সাহিত্যিক সেখানে থাকবে না তা কি হয়! সে জন্যই বাংলা সাহিত্যের নতুনধারার সব্যসাচী লেখক প্রমথ নাথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালে চাটমোহর উপজেলা সদরের হরিপুর চৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। চলিত ভাষাকে তিনি সাহিত্য আসরে সম্মানের আসন করে দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর সেই বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা জায়গা দখল হয়ে গেছে। প্রমথ চৌধুরীর ইশ্বরী পাটনী গল্পের সেই মন্ত্রশক্তির মন্দিরটিও রক্ষা করা হয়নি। চাটমোহরের হান্ডিয়ালের আরেক কিংবদন্তি ঘোষ পরিবার। এরা দই ও মিষ্টির এমন ধারা তৈরি করে যে, কলকাতার সাহেব-বাবুরা হান্ডিয়ালের মিষ্টি ছাড়া কোন কিছুই বুঝত না। কথিত আছে, ইংরেজরা এই এলাকার মিষ্টির জন্য সাত শ’রও বেশি গোয়ালা (ঘোষ) পালন করত। তাদের কাজ ছিল নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে সাহেবদের কাছে পাঠানো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হান্ডিয়ালকে এতটাই গুরুত্ব পায় যে, বিশেষ পরগনা বানিয়ে কয়েক জমিদারকে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রশাসনিক নানা কাজে দায়িত্ব দেয়। হান্ডিয়াল পরগনার সীমানা এতটাই বড় ছিল যে, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে নদী পথেই কয়েক দিন লাগত। ১২৯৪ বঙ্গাব্দের প্রলয়ঙ্করী ভূকম্পনে এই জনপদের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য আজও মেলে। যে কোন স্থান খনন করলে উঁকি দেয় কোন টুকরো। দীঘির নিচে ডুব সাঁতার দিলেও পায়ে শক্ত কিছুর ছোঁয়া মেলে।
×