ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৪ মার্চ ২০১৫

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ২৪ মার্চ, ১৯৭১। একাত্তরের রক্তঝরা এদিন রংপুর, সৈয়দপুর ও চট্টগ্রামে পাক হানাদাররা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ বাঙালীকে হত্যা করে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। আলোচনার নামে কালক্ষেপণের ষড়যন্ত্র নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, আর আলোচনা নয়, এবার সুষ্পষ্ট ঘোষণা চাই। মূলত পাকিস্তান সব নিয়ন্ত্রণই হারায় এই পূর্ব বাংলায়। সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষু আর অস্ত্রের আঘাতকে তুচ্ছ করে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ গোটা বাঙালী জাতি। একাত্তরের এদিনেই সৈয়দপুরসহ বিভিন্নস্থানে অবাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে ঘাতক পাক বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কমপক্ষে ৩ শতাধিক বীর বাঙালীকে হত্যা করে। তবুও স্বাধীনতার প্রশ্নে অকুতোভয় বীর বাঙালী। শুধু নির্দেশের অপেক্ষায়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার পথ থেকে ফেরাতে না পেরে ঘাতক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বিচারে বাঙালী হত্যাযজ্ঞের নীলনক্সা চূড়ান্ত করে। একাত্তরের এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বিভিন্ন সময় সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরামহীন ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা দেন- ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে বাঙালী নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না। ২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে একশ’ নিহত এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। শহরে কার্ফু দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালীরা সম্মিলিতভাবে বাঙালীদের বাড়িঘরে আগুন দেয় ও হত্যা অভিযান চালায়। রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্রুদ্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানী সেনারা সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনারা নৌবন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালী তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পথরোধ করে। সেনাবাহিনী ব্যারিকেট রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ২শ’ শ্রমিক শহীদ হন। মিরপুরে অবাঙালীরা সাদা পোশাকধারী সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালীদের বাড়িঘরের শীর্ষে উঠানো বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানী পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দিন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তাঁর ঘোষণা প্রদান শেষ করা। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘ করতে রাজি নয়। টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভিকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা সকল ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। সাংবাদিকরা জরুরী সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনী সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।
×