ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মশাল প্রজ্বলন আলোর মিছিল ॥ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৬ মার্চ ২০১৫

মশাল প্রজ্বলন আলোর মিছিল ॥ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল ‘কালরাত্রি’ স্মরণে মশাল প্রজ্বলন, আলোর মিছিল, বিভীষিকাময় সেই কালরাতের স্মৃতিচারণ আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে বুধবার ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। গণহত্যার কালরাত্রি স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও নতুন প্রজন্মের হাতের মশাল আর হাজারো প্রজ্বলিত মোম থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা। আলোর মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ২৫ মার্চ স্মরণে প্রতি বছরের মতো এবারও এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বুধবার রাতে নির্মূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসা মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের রণাঙ্গনের সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনীতিক, শহীদ পরিবারের সদস্য ও নতুন প্রজন্মের প্রতিটি সদস্যের মুখে ছিল অবিলম্বে দেশে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ ও রায় কার্যকর, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও প্রগতিবিরোধী অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আলো সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার অঙ্গীকার। অনুষ্ঠানে আগত হাজার হাজার মানুষ বিএনপি-জামায়াত জোটের দেশবিরোধী কর্মকা- প্রতিহত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্নকরণের দাবি তুলে শহীদদের চেতনায় নিজেদের শাণিত করেন। ভয়াল কালরাত্রি স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বাধীনতা ও গণহত্যার ৪৪তম বার্ষিকীতে ৪৪টি মশাল প্রজ্বলন করা হয়। এ সময় শিল্পী জান্নাতুল ফেরদৌসী ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি পরিবেশন করেন। সমবেত জনতাও তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। পরে বের করা হয় আলোর মিছিল। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করা। আলোর মিছিলের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের স্মরণে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গোলাম কুদ্দুছ, কাজী মুকুল, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আলোচনা সভায় নেতারা ‘২৫ মার্চ হোক আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’র সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানের পরে স্বাধীনতার ৪৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৪৪ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা মশাল জ্বালিয়ে আলোর মিছিলের সূচনা করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল করে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তাঁরা। ৪৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই কালরাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালী জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। ঢাকায় হাজারো বাঙালী সেই ভয়াল ও বিভীষিকাময় রাতে শহীদ হয়েছিলেন। চিরআকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এদিন বাংলার সোঁদা মাটি। কালরাত্রির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে আরম্ভ হয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ। সেই ‘কালরাত্রি’ স্মরণে গত ২৩ বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সূচনা করেছিলেন গণহত্যার কালরাত্রি পালন কর্মসূচী। ২৫ মার্চ ‘কালরাত্রি’ স্মরণে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন বেদিতে রাত ১১টা থেকে ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করে। নতুন প্রজন্মকে ‘কালরাত্রির’ নির্মম ঘটনাবলী অবহিত করতে প্রতি বছর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে রাত ১১টা ৫৮ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত সব ধরনের আলো নিভিয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের আহ্বানে এ সময় বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত ও প্রতিষ্ঠানেও আলো নিভিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর রাত ১২টা ১ মিনিটে স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে মশাল ও মোমবাতি প্রজ্বলন করে নতুন প্রজন্মের হাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় মুহূর্তকে স্মরণ করা হয়। ৩৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের হাতে প্রথমে মশাল ও পরে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। এর মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরার প্রতীকী চিত্রও তুলে ধরা হয়। এরপর সমবেত জনতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা এবং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেন। শপথবাক্য পাঠ করান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। এর আগে রাত ১১টা থেকে একক ও দলীয়ভাবে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তি এবং নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে কালরাত্রির ঘটনাবলী স্মরণ করা হয়। এরপর সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্যে আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, মানব ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হামলার রাত ২৫ মার্চ। পাকিস্তানী হানাদাররা ভেবেছিল বর্বরতা চালিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহাকে নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেছিলেন। এখন তরুণ প্রজন্মকে সেই গৌরবের অবিকৃত ইতিহাস জানানো প্রয়োজন। এজন্য এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন। এ সময় কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, আয়োজক সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হারুন হাবীব, যুগ্মমহাসচিব ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শপথবাক্য পাঠের পর সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। গোটা অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। কালরাত্রি স্মরণে বুধবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ সময় গণহত্যায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের স্মৃতিসৌধে প্রদীপ প্রজ্বলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিভিন্ন সংগঠন কালরাত্রি স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে যে কোন মূল্যে রুখে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। প্রজ্বলিত মোমবাতি নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একই ভাবে ঢাকাসহ সারাদেশেই ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত্রি বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে স্মরণ করা হয়।
×