ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিবর্তনের ধারায় ৭ মার্চ, স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৬ মার্চ ২০১৫

বিবর্তনের ধারায় ৭ মার্চ, স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর ইতিহাস

মোরসালিন মিজান ॥ প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। কত কত ইতিহাস যে মিশে আছে এই সবুজে! ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় ৭ মার্চ এখান থেকেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে অবিসংবাদিত নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। একই স্থানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। বাঙালী অর্জন করেছিল কাক্সিক্ষত বিজয়। গৌরবের সেইসব ইতিহাস এখন তুলে ধরছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জায়গাজুড়ে এই স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বহু দূর থেকে চোখে পড়ে সুউচ্চ গ্লাস টাওয়ার। ভাবগাম্ভীর্য ও নয়নাভিরাম সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই টাওয়ার মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগায়। তবে পুরো ইতিহাসটি বর্ণনা করে ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর। একই প্রকল্পের আওতায় এ জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। কেউ কেউ দেখেছেন। অধিকাংশ দর্শনার্থীর জাদুঘর ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ হাজারটা। সেদিকে না গিয়ে ভাল খবরটি দেয়া যাক, আজ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আবারও উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে জাদুঘরটি। সে অনুযায়ী সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এখন থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একইসঙ্গে স্বাধীনতা জাদুঘরটি পরিচালনা করবে। বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট পরিসরে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালীর স্বাধীনতার ইতিহাস। এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৩০০ আলোকচিত্র ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, যতটা সম্ভব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করা হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর। শুরুতে জাতি গোষ্ঠী হিসেবে বাঙালীর পরিচিতি তুলে ধরার প্রয়াস। বাঙালী কত প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী, সেটি স্মরণ করিয়ে দেয় পুন্ড্রবর্ধন ও ওয়ারি বটেশ্বরের আলোকচিত্র। পুন্ড্রবর্ধনের লিপি ও চর্যাপদের উপস্থাপনা বাঙালীর শেকড়ের সন্ধান দেয়। বাঙালী যে গোড়া থেকেই অসাম্প্রদায়িক, সে কথা বলে প্রাচীন কিছু উপাসনালয়ের আলোকচিত্র। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান ধর্মের উল্লেখযোগ্য উপাসনালয়ের আলোকচিত্র রাখা হয়েছে জাদুঘরে। এর পর বলা বেশ কিছু দুর্লভ ছবি ব্যবহার করে বলা হয়েছে উদ্যানের ইতিহাস। সে অনুযায়ী, আজকের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সূচনা মোগল আমলে। তখন এটি ছিল চমৎকার একটি বাগান। নামÑ বাগে বাদশাহ। ব্রিটিশ আমলে এখানে সৈন্যদের থাকার ব্যারেক করা হয়। সেইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতো ঘোরদৌড়। ব্রিটিশ সৈন্যদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতো কুচকাওয়াজ। তেমন একটি ছবিতে দেখা যায় লর্ড কার্জনকে। উদ্যানে গাড়িতে চড়ে সালাম গ্রহণ করছিলেন তিনি। নওয়াবদের আমলে এটি আবার বাগানের চেহারা পায়। এর পর ১৯৪৮ সালের রেসকোর্স। একটি ছবিতে দেখা যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে। অভিবক্ত পাকিস্তানের এই নেতা এখানে নাগরিক সংবর্ধনা নিতে এসে বলছেনÑ একমাত্র উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা! এমন ভয়ঙ্কর দুরভিসন্ধির প্রতিবাদও এখান থেকেই শুরু। এ সূত্রে আসে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটি। বেশ কিছু ছবিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। একে একে আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে সেই উজ্জ্বলতম দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১। বিশাল একটি আলোকচিত্রে দৃশ্যমান হন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আলোকচিত্রটি প্রস্থে ৩০ ফুট। ২০ ফুট উচ্চতা। ফলে অনেক দূরে থেকে দেখা যায়। খুব চেনা এই ছবি। ইতিহাসটি কাউকে বলে দিতে হয় না। হ্যাঁ, স্বাধীনতার ডাক দিচ্ছেন জাতির মহান নেতা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিচ্ছেন। বিশেষ বেদনার সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালী নিধন তথা গণহত্যার ইতিহাস। এজন্য আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে একটি ব্ল্যাকজোন। এ দেয়ালটি অন্ধকার। কালোয় ঢাকা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে নিরীহ বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী বর্বররা যে আক্রমণ চালিয়েছিল, সেই কালো রাতের কথা বলতেই এমন ব্যবস্থা। সেইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের গণহত্যার নানা চিত্র। পাশের গোলাকার একটি কক্ষ নজরকাড়ে খুব। এখানে ৩০ লাখ সন্তান হারানোর শোকে কাঁদছে যেন বাংলা মা। তেমন একটি উপস্থাপনা দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা জাদুঘরে স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাসটিও তুলে ধরা হয়েছে গুরুত্বসহকারে। বহুকাল পরও স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে যারা বিভ্রান্তি ছড়ান তাঁদের মুখে ছাই দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট দলিল রাখা হয়েছে। টাইমস, নিউজউক, ফারইস্টসহ বিশ্বের বেশ কিছু সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ বলছে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতার ভূমিকাও দেখানো হয়েছে আলোকচিত্রে। পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রাণপন লড়ে যাওয়া সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আছে। আছে সেক্টর কমান্ডারদের সবার ছবি। সব শেষে কাক্সিক্ষত বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। এদিনের ইতিহাসটিকেও বিশাল দুটি আলোকচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, আত্মসমর্পণের দলিলে নিজের নাম লিখছেন নিয়াজী। ছবি দুটির নিচে মেঝেতে গ্লাস শোকেস। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে আত্মসমর্পণের দলিল সই করা হয় যে টেবিলটিতে, সেটির রেপ্লিকা। সব মিলিয়ে ছোট পরিসরে চমৎকার একটি উপস্থাপনা। অতি সম্প্রতি স্বাধীনতা জাদুঘর পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে জাতীয় জাদুঘর। বুধবার স্বাধীনতা জাদুঘর পরিদর্শন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সাধারণ দর্শনার্থীদের মতোই বিপুল আগ্রহ নিয়ে গ্যালারি ঘুরে দেখেন তিনি। এ সময় জনকণ্ঠকে মন্ত্রী বলেন, বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান থেকে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতি তুলে ধরছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। এরই অংশ স্বাধীনতা জাদুঘর। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও, মূল ইতিহাসটি বলার চেষ্টা হয়েছে। জাদুঘরটি নিয়ে আরও কাজ করার আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, যা যা প্রয়োজন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তা করা হবে। স্বাধীনতা জাদুঘর সাজানোর পুরো কাজটি করেন জাদুঘরবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। মন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক পরিদর্শন ও সংবাদ সম্মেলনের দিন তাঁকে সেখানে দেখা যায়নি। ফোনে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সীমিত সাধ্য নিয়েই স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাস এখানে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। পরিপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে জাদুঘরটি আরও উন্নত হবে বলে মত দেন তিনি।
×