ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দলের ফান্ড তুলতে জামায়াতপন্থী চক্রটি নিয়োগ বাণিজ্যে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ২ কোটি টাকা

দুষ্টচক্র ভর করেছে বাকৃবি প্রশাসনে ॥ ফেঁসে যাচ্ছেন ভিসি!

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩০ মার্চ ২০১৫

দুষ্টচক্র ভর করেছে বাকৃবি প্রশাসনে ॥ ফেঁসে  যাচ্ছেন ভিসি!

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ ঘাপটিমারা দুষ্টচক্র ভর করেছে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথাভারি প্রশাসনে। আওয়ামী লীগের খোলসে বিএনপি জামায়াত চক্রটি উপাচার্যের চার পাশ ঘিরে রেখে ফায়দা হাতিয়ে নিয়েছে। অভিযোগ কেবল জামায়াতপন্থী চক্রটি দলের ফান্ড সংগ্রহে উপাচার্যকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর পুরো নিয়োগ বাণিজ্যে লেনদেন হয়েছে অন্তত ২০ কোটি টাকা! চিহ্নিত দুষ্টচক্রের কারসাজিতে এখন ফেঁসে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল হক। নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে কাবু উপাচার্যের মাথায় এখন নতুন করে নারী কেলেঙ্কারির খ—গ ঝুলছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রক্টোরসহ প্রশাসনের আওয়ামী লীগপন্থী ৫৫ শিক্ষকের পদত্যাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন সবকিছু ম্যানেজের জন্য উপাচার্য অকাতরে টাকা ছড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, নিয়োগ বাণিজ্যসহ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অভিযোগের তদন্ত করতে আগামী ২-১ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিতে ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে পেছনের তারিখে তড়িঘড়ি করে কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টিও তাদের নজরে এসেছে বলে জানান এই শিক্ষাবিদ। তদন্তে প্রমাণিত হলে জড়িত কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না বলে জানান তিনি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। নিয়োগ বাণিজ্যের পর নারী কেলেঙ্কারির অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার পর থেকে নৈতিক স্খলের অভিযোগ এনে উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশসহ আন্দোলনে নেমেছে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম। আন্দোলনে নামার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি। অপরদিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে মানববন্ধনসহ সভা সমাবেশ করছে কর্মকর্তা কর্মচারীসহ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ইউনিট কমান্ড। এসবের বাইরে নারী কেলেঙ্কারির তদন্ত ও ক্যাম্পাসকে শান্তিপূর্ণ রাখার দাবিতে মানববন্ধনসহ সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জহিরুল হক খন্দকার, প্রক্টোর অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদসহ প্রশাসনের সাত কর্মকর্তা দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনের ৪৮ কর্মকর্তা একযোগে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব অভিযোগ অস্বীকার করে আন্দোলনকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল হক জনকণ্ঠকে জানান, সুবিধা নেয়া মহলটি যখন বুঝতে পেরেছে উপাচার্যের মেয়াদ প্রায় শেষ এবং নতুন করে আর কোন সুবিধা পাওয়ার আশা নেই- তখনই নানা যড়যন্ত্রসহ অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। উপাচার্য হওয়ার খায়েস রয়েছে এমন শিক্ষক নেতারাও এই অপপ্রচারে লিপ্ত বলে দাবি উপাচার্যের। উপাচার্য আরও জানান, অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এদিকে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম সভাপতি অধ্যাপক ড. একেএম শামসুদ্দিন জানান, উপাচার্যের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত মানববন্ধন ও সমাবেশসহ চলমান আন্দোলন চলবে। উপাচার্যকে চাপে রাখতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা ফোরামের ৫৫ শিক্ষক পদত্যাগ জমা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিএনপিপন্থী সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার শরীফুল ইসলাম জানান, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণে ২৯ মার্চ সোমবার সমিতির সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। সমিতি নেতৃবৃন্দ গত বুধবার দুপুরে উপাচার্যের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে উপাচার্যকে নির্দোষ প্রমাণের পরামর্শ দিয়েছেন। তুরুপের তাস নারী কেলেঙ্ককারি ॥ নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড়ের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন বিপর্যস্থ, তখন তুরুপের তাসের মতোই ফাঁস হয়েছে তৃতীয় শ্রেণীর এক দাপুটে নারীর কেলেঙ্কারির কাহিনী। কাহিনীর নায়িকা নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে আসা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের এক কর্মী। প্রায় দুই বছরের চাকরি জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘনিষ্ট বলে আলোচিত ওই মহিলা অপারেটর কেবল অগাধ সম্পদের পাহাড়ই গড়েননি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাকরি করেছেন দাপটের সঙ্গে। উপাচার্য ঘনিষ্ট হওয়ার সুবাধে নিয়ম নীতি ভেঙ্গে ক্যাম্পাসে কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দের বাসাও বাগিয়ে নেন তিনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচিত ৩০২ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও ২-৩ জন কর্মচারী নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। উপাচার্যের ঘনিষ্ট বলেই এসব সুযোগ ও সুবিধা বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন উক্ত মহিলা অপারেটর। প্রচার রয়েছে, উপাচার্যের সঙ্গে অডিও ফোনালাপ ও ভিডিও ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়েই সবকিছু কড়ায় গ-ায় আদায় করে নিয়েছেন ওই বিতর্কিত নারী কর্মচারী। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগকে সামনে রেখে একটি মহল উপাচার্যকে ব্ল্যাকমেইল ও ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে চাহিদার নিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলোর দাবি, মোটা অঙ্কের নিয়োগ বাণিজ্যে ভাগ বসাতেই বিভিন্ন মহল পরিকল্পিতভাবে আলোচিত ওই মহিলা অপারেটরকে ব্যবহার করে এই ফোনালাপের ফাঁদ পাতে। আর এই ফাঁদে পা দেন উপাচার্য। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য ক্যাম্পাসে এলে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের কিছু শিক্ষক নেতা নৈতিক স্খলনের অভিযোগ এনে উপাচার্যকে অনুষ্ঠানস্থল থেকে চলে যেতে বলেন। এ সময় প্রক্টোর ও গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম নেতাদের মধ্যে উত্তেজনা ও হট্টগোল দেখা দেয়। এরপর থেকে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ এনে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে। চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা ফোরামের ৪৮ শিক্ষক রেজিস্ট্রারের কাছে গত ২৪ মার্চ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। রবিবার উপদেষ্টা ও প্রক্টোরসহ আরও ৭ শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। এ নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণে ২৯ মার্চ সোমবার বিএনপি জামায়াতপন্থী বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি নেতৃবৃন্দ সমিতির সাধারণ সভা ডেকেছেন। ছাত্রলীগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোর্শেদুজ্জামান খান জানান, ‘আমরা নিরপেক্ষ’। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার দাবিতে ছাত্রলীগে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচী পালন করেছে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিজয় একাত্তরের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে কর্মচারীসহ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ইউনিট। এরকম পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী ও আন্দোলনে ক্যাম্পাস আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক প্রেমাংশু মজুমদার ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি করে জানান, নারী কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর উপাচার্য এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। ছাত্রফন্ট্র বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কিশোর আহমদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এরকম লজ্জাজনক ঘটনা এটিই প্রথম। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজ বিব্রত ও লজ্জিত। এদিকে এই অডিও ফাঁস হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন বিতর্কিত এই নারী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে গত ১৮ মার্চ এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে কর্মচ্যুত করেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দীন হাওলাদার বাদী হয়ে গত ২৩ মার্চ কোতোয়ালি মডেল থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে এই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ঘটনা তদন্তে উপাচার্য ঘনিষ্ট বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল আউয়ালকে প্রধান ও উপাচার্য সচিবালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শাহ মুহসিননুল হক শাওনকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে গত ২৩ মার্চ। কমিটিকে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে রোজীর নামে বরাদ্দের বাসাটি। নিয়োগ বাণিজ্য থেকে জামায়াতের ফান্ড ॥ কর্মকর্তাসহ ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ৩০২টি পদের নিয়োগ বাণিজ্য থেকে জামায়াত মোটা অঙ্কের ফান্ড সংগ্রহ করেছে বলে প্রচার রয়েছে। এই অঙ্ক ২ কোটি টাকার ওপরে। অভিযোগ উপাচার্যের চারপাশ ঘিরে রাখা ও ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতপন্থী শিক্ষক নেতা চক্র এই অর্থের ফান্ড হাতিয়ে নিয়েছে। ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার জামায়াতপন্থী শিক্ষক নেতা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা ইউসুফ আলী ম-লের মাধ্যমে এই লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকে জামায়াতপন্থী এই শিক্ষক আত্মগোপনে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘনিষ্ট সূত্রের দাবি, নিয়োগ ও লেনদেন শেষে এই শিক্ষক নেতা, মাজাহার ও কয়েক দালাল টাকা নিয়ে ঢাকা মহানগর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা নুরল ইসলামের বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন বলে জানা গেছে। উপাচার্যের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে কয়জন নেতা প্রভাব বিস্তার করে একটি বিশেষ বলয় তৈরি করেন ইউসুফ আলী ম-ল তাদের অন্যতম। প্রচার রয়েছে ইউসুফ ম-ল একাই বাগিয়ে নেন নিজ এলাকার ১৮ জন ও স্থানীয় বয়রা এলাকার লজিং বাড়ির ৫ জনসহ ২৩ জনের নিয়োগ। প্রতিটি নিয়োগে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় সূত্র। বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক নেতা এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেননি। বাদ পড়েনি ছাত্রলীগ নেতারাও। তবে সবচেয়ে বেশি অর্ধশত কর্মচারীর নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন ময়মনসিংহের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষীয় সূত্র জানায়, বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদে ২৯৯ জন কর্মচারী ও ১২৯ জন কর্মকর্তা ছাড়াও ৫ জন সহকারী অধ্যাপক ও ১৪৫ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। স্থানীয়দের দাবি এসব নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠলেও বহাল তবিয়তে থাকেন তিনি। সর্বশেষ চলতি সালের গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর করা ৩০২ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাইরে। অভিযোগ কর্মকর্তাদের ১৬টি শূন্যপদসহ ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর ৩০২টি পদে কর্মচারী নিয়োগে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মোটা একটা অংশ গেছে জামায়াতের ফান্ডে! গত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে এসব পদের জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরুতেই এর স্বচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম নেতৃবৃন্দ। নিয়োগে আর্থিক লেনদেন ও অনিয়মের অভিযোগ এনে ফোরাম নেতৃবৃন্দ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এক আবেদনে তদন্তের দাবি জানান। এর প্রেক্ষিতে মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)কে দায়িত্ব দেন। তদন্ত কার্যক্রম চলমান অবস্থায় উপাচার্য তড়িঘড়ি করে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। ফোরাম নেতৃবৃন্দের আপত্তির মুখে শিক্ষামন্ত্রী এই নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছিলেন গত ১৭ জানুয়ারি। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি মেয়ের বিয়ের মানবিক কারণ দেখিয়ে উপাচার্য এই স্থগিতাদেশের সীমা চাপা দেন। স্থানীয় বয়রা ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও শহরতলী দীঘারকান্দা এলাকার সাদির নিয়োগ পেয়েছেন ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে। একই এলাকার ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক লিটনও নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীঘারকান্দা, বয়রা, শেষ মোড়, চরনিলক্ষীয়াসহ স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও জামায়াত ঘরানার অনেকে বাগিয়ে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীর পদ। এসব প্রতিটি নিয়োগে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুল বারেকের মাধ্যমে বিএনপি ও যুবদল কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের যেসব নেতা নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন প্রত্যেকে ৭-৮টি নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবু হাদী নূর আলী খান একাই ১৫টি, প্রক্টোর, এডভাইজর, ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহসিন আলী, সদস্য সচিব এডিশনাল রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী ম-ল, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মোমেন, সদস্য সচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুল বারেক প্রত্যেকে ১০-১৫টি করে, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আফতাব পুত্র কন্যাসহ ৫-৬ জন, উপাচার্যের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাজহার ও জজমিয়া ৫-৬টি, ডেপুটি রেজিস্ট্রার আরিফ জাহাঙ্গীর ৩টিসহ অনেকে বাগিয়ে নেন চাহিদার পদ। কমিটি সচিবের নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করা কথা থাকলেও পরে তাতে স্বাক্ষর করেন রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেক। মন খুশির জন্য তাকে দিতে হয় ২০টি পদ! ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর আলাদা নিয়োগ কমিটি সদস্য সচিবদের কর্মচারীদের নিয়োগপত্রে স্বাক্ষরের নিয়ম থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কেন স্বাক্ষর করেছেন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য জানান, সেটি রেজিস্ট্রারই ভাল বলতে পারবেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, তড়িঘড়ি ও অনিয়মের নিয়োগ বাণিজ্যে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে শেষ মূহূর্তের বিরোধে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিবরা বেকে বসলে রেজিস্ট্রারকে দিয়ে উপাচার্য নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রেওয়াজ মতে প্রার্থীদের প্রাথমিক বাছাই শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু এটি মানা হয়নি। পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই এমনটি করা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। জাতীয় পার্টির স্থানীয় এক নেতা ও ঠিকাদারও বাগিয়ে নেন ৫-৬টি পদ। আলোচিত এই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে উপাচার্য ও তাঁর স্ত্রীর নামও রয়েছে। উপাচার্য ঘনিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, আওয়ামী লীগ খোলসে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট উপাচার্যের স্ত্রী, রেজিস্ট্রার, ইউসুফ ম-ল ও কতিপয় দালালের সহায়তায় নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে উপাচার্যকে বেকায়দায় ফেলে এখন সটকে পড়েছে। সুবিধাবাদীদের অনেকে এখন উপাচার্য অপসারণ দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছে বলে দাবি স্থানীয় সূত্রের। নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনায় রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে হামলাসহ ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টার কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, শহরের কেওয়াটখালি বাইপাস রোডের হাবিবুর রহমান আবেদন করেন করণিক পদে। অথচ তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কাঠ মিস্ত্রি পদে! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শাখা থেকে কাঠ মিস্ত্রি পদে কর্মচারী নিয়োগে চাহিদা দেয়া হয়েছিল। একই শাখা থেকে ইলেকট্রিশিয়ান পদের চাহিদার বিপরীতে আনিসুল হককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে করণিক হিসেবে। শহরের নাটকঘর লেন এলাকার মুক্তা রানী ভদ্রকে প্রকৌশল শাখার শূন্য পাম্প ড্রাইভারের বিপরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সর্টার হিসেবে। কর্মকর্তাদের দাবি একজন নারীর পক্ষে দিনে রাতে পাম্প ড্রাইভার পদে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। পদ খালি নেই কিংবা প্রয়োজন নেই এমন পদে অনেক অদক্ষ কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানায় প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তারা। পদ খালি না থাকায় কোন কর্মচারীর চাহিদা দেয়া হয়নি গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। তারপরও এই বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানান বিভাগ প্রধান অধ্যাপক ড. পরেশ চন্দ্র মোদক। ইউজিসির তদন্ত কমিটি ॥ উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা তদন্তের দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান, ফসল উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত বছরের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক মোহব্বত খানকে আহ্বায়ক এবং ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক আবুল হাশেম ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) জিকরুর রেজা খানমকে সদস্য করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। কমিটি প্রধান দেশের বাইরে থাকায় তদন্তে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এরই মধ্যে তিনি দেশে ফিরেছেন। অভিযোগ তদন্তে কমিটি সদস্যরা আগামী ২-১ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন বলে জানিয়েছেন কমিটি সূত্র। ইউজিসির পত্রে তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে বলা হয়েছিল।
×