ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থার কথা ভাবছে গোটা দুনিয়ার এ্যাভিয়েশন শিল্প

জার্মানউইংস বিমান দুর্ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ ককপিটের নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ মার্চ ২০১৫

জার্মানউইংস বিমান দুর্ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ ককপিটের নিরাপত্তা

আজাদ সুলায়মান ॥ একটি উড়োজাহাজের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হচ্ছে ককপিট। এখানেই বসেন পাইলট ও কো-পাইলট। উড়োজাহাজটির নিরাপদ উড্ডয়ন ও অবতরণ সবটাই নির্ভর করে এ দুজনের ওপর। মূলত উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই তৈরি হয় বিমান ঘিরে নিরাপত্তার খুঁটিনাটি ব্যবস্থা। সে জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় ককপিটের নিরাপত্তাকে। কিন্তুুু সেই ব্যবস্থাতেও যে অন্য ‘বিপদ’ রয়েছে, তা দেখিয়ে দিল জার্মান উইংস বিমানের দুর্ঘটনা; যেটা গত বুধবার দুর্ঘটনার শিকার হবার পর এখন বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন অবিশ্বাস্যসব সংবাদ। সর্বশেষ তথ্য মতে, ওই জাহাজের পাইলট টয়লেটে যাবার পর তাকে আর ঢুকতে দেননি কো-পাইলট। ফলে কো-পাইলট নিজেই ককপিটের দরজা বন্ধ করে মুহূর্তেই উড়োজাহাজটি নিয়ে ইচ্ছাপূর্বক পাহাড়ে গুঁড়িয়ে দেন। তাতে নিহত হন ওই পাইলটসহ ১৫০ জন। কো-পাইলটের এহেন পাগলামিতে পৃথিবীর নামকরা তাবত এয়ারলাইন্সকে ভাবিয়ে তুলেছে। কি করে এ জাতীয় ঘটনা এড়ানো যায় সেটার দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানও এতে উদ্বিগ্ন। বিমানেও মাঝে মাঝে এ ধরনের গাফিলতিবশত পাইলট শুধু কো- পাইলটকেই ককপিটে রেখে টয়লেটে যান। তবে এ জাতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনা এড়াতে ককপিটে বসা ও বের হবার নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য নতুন করে তাগিদ দেয়া হয়েছে বিমানের ককপিট ক্রুদেরও; যদি কেউ তা ভঙ্গ করে তাহলে নেয়া হবে কঠিন শাস্তি। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বিমান পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ককপিটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে বিমানেও। এটা আগেও কার্যকর ছিল। এখনও আছে। জার্মান উইঙ্গসের দুর্ঘটনার পর পরই আমি বিমানের ম্যানেজমেন্টকে সেটা আবার নতুন করে তাগিদ দিয়েছি; যাতে শতভাগ সেটা মেনে চলা হয়। তিনি জানান, ওয়ান-ইলেভেন পর আমেরিকাসহ দুনিয়ার অনেক এয়ারলাইন্সে এ নিয়ম মানার ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিমানেও সেটা সেভাবেই মানা হচ্ছে। এ নিয়ে গাফিলতির কোন সুযোগ নেই। এ অভিযোগ সম্পর্কে বিমানের ভারপ্রাপ্ত এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ককপিটের এ নিয়ম সবাই মেনে চলে। কেউ অমান্য করেছে কিনা এমন কোন অভিযোগ বা রিপোর্ট আজ পর্যন্ত বিমানের গোচরীভূত হয়নি। তেমন অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। ককপিটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়মাবলী কি ? জানতে চাইলে বিমানের সাবেক এমডি শেখ নাসির উদ্দিন, যার রয়েছে এয়ারবাস ও ডিসি-১০সহ অন্যান্য মডেলের উড়োজাহাজ ওড়ানোর ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন জনকণ্ঠকে, ককপিট ছেড়ে প্ইালট টয়লেটে যাবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা রয়েছে। সে নিয়ম বিমানসহ দুনিয়ার সব এয়ারলাইন্সে মেনে চলা হয়। যেমন পাইলট ককপিট টয়লেটে যাবার আগে অবশ্যই আরও একজন কেবিন ক্রুকে ডেকে এনে কো-পাইলটের পাশে বসিয়ে যাবেন। যাতে ককপিটের একক নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারেন কো-পাইলট। বিমানেও এ নিয়ম মানার অফিসিয়াল আদেশ রয়েছে। সবাই তা মেনে চলে । যদি কেউ অমান্য করে থাকে সেটা শাস্তিযোগ্য। কারণ ককপিটের নিরাপত্তা শুধু পাইলট, কো-পাইলটের জন্য নয়, সব যাত্রীরও জানমালের নিরাপত্তা আল্লাহর পরে নির্ভর করে তাদের ওপর। এ বিষয়ে তিনি জানান, উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের আশঙ্কা মাথায় রেখেই ককপিটের দরজা ‘বুলেট প্রুফ’ করা হয়। বাইরে থেকে গুলি করলেও সেই দরজার কোন ক্ষতি হয় না। নিরাপত্তার খাতিরেই ককপিটের ভেতরে এমন ব্যবস্থা থাকে যে পাইলটের অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না। দু’জন পাইলটের একজনও যদি ককপিটের বাইরে যান, তা হলে তার ঢোকাটাও ককপিটের ভেতরে থাকা দ্বিতীয় পাইলটের মর্জির ওপর নির্ভর করে। ককপিটের ভেতরে এমন একটি লিভার রয়েছে, যা একদিকে চেপে ধরে রাখলে বাইরে থেকে অন্য কারও ককপিটে ঢোকা অসম্ভব। অনেক পাইলটেরই ধারণা, দুর্ঘটনাগ্রস্ত জার্মান উইঙ্গস বিমানের কো-পাইলট ওই লিভারটি চেপে ধরেছিলেন বলেই বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছে বুঝেও পাইলট বা অন্য কেউ ককপিটে ঢুকে তা আটকানোর চেষ্টা করতে পারেননি। এ্ প্রসঙ্গে শেখ নাসের বলেন, প্রতিটি ককপিটের দরজার বাইরে একটি নম্বর বোর্ড থাকে। সেই ককপিটে ঢোকার একটি নির্দিষ্ট ও গোপনীয় কোড ন¤বর থাকে। যে নম্বর ওই বিমানের দুই পাইলট এবং মুখ্য বিমানসেবিকার কাছে থাকে। ককপিটে পাইলটদের চা-পানির প্রয়োজন হলে প্রথমে বাইরের ওই নম্বর বোর্ডে থাকা একটি বেল বাজান বিমানসেবিকারা। কখনও আবার কেবিন থেকে ফোন করে ককপিটে ঢোকার অনুমতি চান। তারা ওই কোড ব্যবহার করেন না। ককপিটের লিভারের একদিকে থাকে ‘আনলক’, অন্যদিকে থাকে ‘লক’ বা ‘ওভাররাইড’। মাঝে থাকে ‘নরম্যাল’ বা ‘নিউট্রাল’। লিভার সব সময় নরম্যাল বা নিউট্রাল অবস্থায় থাকে। দরজা খোলার দরকার হলে লিভারটি ‘আনলক’ অবস্থানে আনা হয়। লিভার ছেড়ে দিলে স্প্রিং থাকায় তা ফিরে যায় নিউট্রালে। কিন্তু ওভাররাইড বা ‘লক’ ব্যবস্থাটা কী জানতে চাইলে অপর এক পাইলট জনকণ্ঠকে বলেন,্ আকাশে উড়োজাহাজে ছিনতাইকারীরা যদি প্রধান বিমানসেবিকার মাথায় বন্দুক ধরে, তা হলে তার কাছ থেকে কোড নম্বর জেনে নিয়ে তারাও ককপিটে ঢুকতে পারে। এতে সহজেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেতে পারে। এটা আটকাতেই ওই ‘ওভাররাইড’ ব্যবস্থা। কেউ কোড নম্বর ব্যবহার করলেই ককপিটের ভেতরে আলো জ্বলে উঠবে। ককপিটে রাখা একটি মনিটরে ফুটে উঠবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ছবি। পাইলট তখন সেই লিভার ব্যবহার না করলেও দরজা কয়েক সেকেন্ড পরে আপনাআপনি খুলে যাবে। কিন্তু মনিটরে যদি পাইলট দেখেন বাইরে সন্দেহজনক কেউ রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে লিভারটি ‘ওভাররাইড’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে, কোড নম্বর ব্যবহার করলেও আর দরজা খোলা সম্ভব হবে না। ককপিটের ভেতরে থাকা পাইলট কিংবা কো-পাইলটই একমাত্র পারেন ওভাররাইড ব্যবস্থা থেকে ককপিটের দরজা খুলতে। জার্মান উইঙ্গসের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ফুটে উঠেছে, অভিশপ্ত বিমানের ককপিটে থাকা কো-পাইলটও ওই ‘ওভাররাইড’ জায়গায় নিয়ে গিয়ে চেপে ধরেছিলেন লিভার। ছেড়ে দিলেই সেই লিভারের নিউট্রাল অবস্থায় ফিরে আসার কথা ছিল। যার অর্থ, অন্য পাইলট যাতে ককপিটে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কো-পাইলট আটকে রেখেছিলেন দরজা। ককপিটে একা থাকার সময় যদি আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হন পাইলট? যদি তার হাতের চাপে লিভার ‘ওভাররাইড’ জায়গায় আটকে যায় তখন কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এক দক্ষ বৈমানিক জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানে নিয়ম রয়েছে, একজন পাইলট কোন কারণে ককপিট থেকে বাইরে এলে, বেরুনোর সময় যে কোন একজন বিমান সেবক বা সেবিকাকে ককপিটে রেখে যাবেন। এই নিয়ম না মানলে শাস্তি অবধারিত। ককপিটে একা থাকার সময় অন্য পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন দরজা খুলে দেয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা মেনে চলি। আমেরিকার পাইলটরাও এই নিয়ম মানেন। কিন্তু, ইউরোপের পাইলটরা অনেক ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানেন না। জার্মান উইঙ্গসের হতভাগ্য বিমানটির পাইলট যদি কো-পাইলটের পাশে একজন সেবক কিংবা সেবিকাকে ককপিটে রেখে যেতেন তাহলে এমনটা ঘটত না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন আহমেদ ফজলুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কি করলে কি ঘটত এসবই এখন অনুমাননির্ভর। জার্মানির ঘটনার পর গোটা দুনিয়ার এ্যাভিয়েশন শিল্পকে নতুন করে ভাবতে হবে। এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বের করতে হবে আরও কার্যকর ব্যবস্থা। এদিকে জার্মান উইঙ্গসের ঘটনার পরে ককপিটের নিরাপত্তা বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পাইলটের হাত থেকে নিয়ে অন্য কারও হাতে দেয়া উচিত কিনা এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মাঝে। ইতোমধ্যে দুনিয়ার সেরা এয়ারলাইন্সগুলোর পাইলটরাও এ নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। বেশিরভাই পাইলটের মতে, পাইলটের হাতেই থাকে বিমানের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ। তা কেড়ে নিলে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে। কারণ, যাত্রীবোঝাই বিমান নিয়ে পাইলট মরণঝাঁপ দিচ্ছেন, এমন ঘটনা খুব বেশি শোনা যায়নি। যদিও এমন মাত্র দুটি ঘটনার কথা তারা জানেন। ১৪ বছর আগে সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের একটি বিমান এবং বছরপাঁচেক আগে আফ্রিকার একটি বিমানের ক্ষেত্রে এমন ঘটেছিল। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য কী করা উচিত? পাইলটরা বলছেন, পুরো বিষয়টা ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট সময়ের মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে ককপিটের মধ্যে পাইলট এবং কো-পাইটের একজনের অনুপস্থিতির সময় একজন বিমানসেবিকার উপস্থিতি সর্বত্র বাধ্যতামূলক করা হলে অন্তত জার্মান উইঙ্গসের মতো পরিণতি অনেকাংশেই ঠেকানো যাবে বলে অভিমত এ দেশের পাইলটদের। এদিকে সর্বশেষ জানা যায়, দক্ষিণ ফ্রান্সে লুফৎহানসার সহযোগী জার্মান উইঙ্গস বিমানের দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, বিমানটি ভেঙ্গে পড়ার ঠিক আগে ককপিটে একা বসে বিমান চালাচ্ছিলেন কো-পাইলট। ককপিটের দরজার সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রধান পাইলটকে তিনি ঢুকতেই দেননি ভেতরে। বিমান সোজা আছড়ে পড়েছে পাহাড়ের কোলে। মারা গিয়েছেন দেড় শ’ মানুষ। মূলত তিনি বান্ধবীর সঙ্গে মনোমালিন্য জনিত কারণে মানসিক ব্যাধিতে ভুগছিলেন বলেই এমন কা- ঘটিয়েছেন।
×