ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাদ্রাসা শিক্ষা ও লাল সালু’র রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১ এপ্রিল ২০১৫

মাদ্রাসা শিক্ষা ও লাল সালু’র রাজনীতি

‘শষ্যের চেয়ে টুপি বেশি ধর্মের আগাছা বেশি।’ ‘লাল সালু’র (১৯৪৮) মজিদের জন্মস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্র বলা এ কথা আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেও মনে পড়তে পারে। বিশেষ করে ভারতীয় দৈনিক ‘দ্যা হিন্দু’র দশ মার্চ দু’হাজার পনেরোয় প্রকাশিত সাইফ কামালের প্রতিবেদনটি পড়লে। তিনি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় চৌষট্টি মিলিয়ন বা ছয় কোটি চল্লিশ লাখ ছাত্র কাওমী মাদ্রাসায় পড়ছে। মাদ্রাসার সংখ্যা আঠারো হাজার এক শ’। শিক্ষকদের মধ্যে শতকরা বিরাশি ভাগের কোন প্রশিক্ষণ নেই। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্্ বেঁচে থাকলে হয়ত শস্য ও টুপির এখনকার পরিসংখ্যান সঠিক বলতে পারতেন। তাঁর মজিদ যেখানে জন্মেছিল সেখানে অভাব মানুষের নিত্যসঙ্গী, দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকে। সামান্য ধর্মীয় শিক্ষা সম্বল করে মজিদকে তাই ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়তে হয়। শস্যসমৃদ্ধ গ্রাম মহব্বতপুরে পৌঁছে মজিদ ভাগ্যোন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা খুঁজে পায় সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে। এসব পুঁজি করে চতুর মজিদ একসময় সম্পদের মালিক হয়। সাধারণ মানুষের চেতনার স্তর নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার কাজটি সে নিপুণভাবে করে। কারণ, সে জানে জ্ঞান চক্ষু খুলে গেলে তার সব কপটতা ধরা পড়বে। মজিদ রাজনৈতিক নেতা না হয়েও তথাকথিত দক্ষ রাজনীতিই করেছে আসলে। জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে। ধর্মের মুখোশ পরে যেমনটা করেন বুর্জোয়া সমাজের সামন্ত মানসিকতার রাজনীতিবিদরা। মজিদের মতো ধর্মের কপটরক্ষক হয়ে স্বাধীনতার পর এদেশে যিনি আমদানি হয়েছিলেন কাকতালীয়ভাবে তার নামও মজিদ। মজিদ খান। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রথমেই তিনি ধর্মশিক্ষা ও আরবী ভাষা স্কুল পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারও আগে যার মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রীর পদটি তিনি অলঙ্কৃত করেছিলেন সেই জেনারেল শাসক জিয়া ক্ষমতায় বসেই সৌদি প্রবাসী বাঙালী প-িতদের নিয়ে ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন করেছিলেন। সেখান থেকেও সুপারিশ এসেছিল শিক্ষার সর্বস্তরে আরবী ভাষা বাধ্যতামূলক করার। জেনারেল জিয়ার হঠাৎ করে কেন এত ধর্মপ্রীতি জেগেছিল? ধর্মকর্মের জন্য তার তেমন সুখ্যাতির কথা আগে কেউ শোনেনি। তার শিক্ষামন্ত্রীর কথা শোনা গেছে আরও কম। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করার পর তিনি দেশেই ছিলেন না। শিক্ষা ও কর্মজীবন তার কেটেছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ধার্মিক হিসেবে তার সুখ্যাতির কোন রেকর্ড নেই। তাহলে? ওই যে লাল সালুর মজিদকে যে কারণে ধার্মিক হতে হয়েছিল, তাদেরও সে জন্য ধর্মের মুখোশ পরতে হয়েছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমাজে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একজোট হচ্ছে- এসব আলামত শুভ নয় শাসকদের জন্য। একে দমন করার মোক্ষম দাওয়াই জনগণের ধর্মীয় আবেগকে আলোড়িত করা। একবার তা করতে পারলে শাসকের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ওই আবেগের বন্যায় ভেসে যাবে। রাজনৈতিক চেতনা ভেঙ্গে খান খান হবে। সুতরাং সামন্ত মজিদের ভূত তথাকথিত বুর্জোয়া মজিদ ও তার প্রভুদের ঘাড়ে চেপে একেবারে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি খামচে ধরেছিল এবং বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্য ওই চেপে বসা ভূত আর নামেনি। পরের স্বৈর ও গণতান্ত্রিক শাসকরা একে আরও নিপুণভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের প্রতি আস্থাশীল থেকে প্রথম থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দিয়ে সবার জন্য একক সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে রাষ্ট্র পরিচালকরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সব সময় জোর দিয়ে এসেছেন। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসার প্রয়োজন হয় না। সেজন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিভাগ খোলাই যথেষ্ট। কিন্তু উদ্দেশ্য যেখানে অসৎ সেখানে ছলের অভাব হয় না। শামসুল হক শিক্ষা কমিশন মাদ্রাসা শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘোষণা করে বলেছিল, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন করা। শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুল (সা) এর প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা, যেন এই বিশ্বাস তার সমগ্র চিন্তা ও কর্মে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে’...‘মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ইসলামের যথার্থ সেবক ও রক্ষকরূপে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তারা ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতিকে ভাল করে জানে, সে অনুসারে সুদৃঢ় নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ও তার উন্নয়ন বিধানে উদ্যোগী হয়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না এই ‘নির্ভরযোগ্য ও সুদৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের কোন সন্তান মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয়নি। সমাজের ওপরতলার ধনবান মানুষদের সন্তানরাও চরিত্র গঠন বা ‘ইসলামের রক্ষক’ হওয়ার জন্য মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয় না। গালভরা বুলি কপচে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যতই মহীয়ান করা হোক, এ শিক্ষা আসলে নিচুতলার মানুষদের সন্তানদের জন্য। শিক্ষা ব্যবস্থার চরম বৈষম্যের নিদর্শন হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা, জনগণের এক বড় অংশের ধর্মীয় পশ্চাৎপদতাকে ব্যবহার করে এ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে এদের ব্যবহার করেছে। এই পাল্টাপাল্টি ব্যবহারে আগাছার মতো বেড়েছে মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্রসংখ্যা। এখন এর সংখ্যা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠলেও এ বাস্তবতা এদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই সৃষ্টি- এ আত্মসমালোচনা প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই করতে হবে। শিক্ষা সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সমাজের লক্ষ্যের সঙ্গে এর লক্ষ্য জড়িত। সামন্তবাদী সমাজে শিক্ষার যে প্রয়োজন, পুঁজিবাদী সমাজের প্রয়োজন তা থেকে আলাদা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের চাহিদা মেনে এক সময় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু যখনই সমাজে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, সমাজ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেক্যুলার মননচর্চার পরিসর তৈরি হয়েছে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের পরিচয় ঘুচিয়ে সেক্যুলার মননচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনে কারও পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল নির্ভেজাল ধর্মচর্চার জন্য? অথচ এ দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যেমন ছিল আজও তেমনই আছে। সময়ের পরিবর্তনের কোন ছাপ এতে পড়েনি। পড়তে দেয়ার উদ্যোগও সেভাবে নেয়া হয়নি। বড় রাজনৈতিক দলগুলো এসব মাদ্রাসাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের ভোটব্যাংক হিসেবে রিজার্ভ রেখেছে। সভ্য দুনিয়ার আলো-বাতাসহীন ওই বদ্ধ কুয়া যদি এখন জঙ্গীবাদের ঘাঁটি হয় তাহলে কাকে দোষ দেয়া যাবে? ভেবে দেখার সময় এসেছে। সমাজের প্রবণতাই নির্ধারণ করে শিক্ষার স্বরূপ। শুধু মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশের এখনকার সামাজিক প্রবণতার চিত্র ফুটে ওঠে।
×