ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

মার্কিনীদের ‘ফাটকামি’তে আটকা পড়েছি

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৩ এপ্রিল ২০১৫

মার্কিনীদের ‘ফাটকামি’তে আটকা পড়েছি

ব্যাংকে গিয়েছি টাকা তুলতে। যথারীতি লাইনে না দাঁড়িয়ে চলে গেলাম পরিচিত এক অফিসারের কাছে। সে আমাকে কিছুটা খায়-খাতির করে। অতএব তার শরণাপন্ন হই। চেয়ারে বসতে বসতেই দেখি আরেক ভদ্রলোক ‘এ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরম’ পূরণ করছেন। তাঁকে সাহায্য করছে পরিচিত অফিসার। আমি তাড়াতাড়ি না করে বললাম, তোমার কাজ শেষ করো, তারপর আমার কাজ। ইতোমধ্যে চা আসল। এটা অফিসার বন্ধুটি সবসময়ই করে। শুনতে পাচ্ছিলাম নতুন হিসাব খুলতে আসা ভদ্রলোকের নানা রকম মন্তব্য। ‘নো ইউর কাস্টমার’ (কেওয়াইসি), ‘ট্রানজেকশন প্রোফাইল’ (টিপি) ফরম পূরণ করতে করতে ভদ্রলোক বলছিলেন, বাংলাদেশে আরও কত কিছু দেখব। কাজ নেই তো খৈ ভাজ। অথচ দেখা যাচ্ছে যে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য এত সবের আয়োজন সেই দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং দিন দিন বাড়ছে। বেহুদা কাগজ বাড়ানো হচ্ছে। মাঝে মাঝে এসব বলতে বলতে ভদ্রলোক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন। আর অফিসার ভদ্রলোক বার বার হিসাবধারীকে বলছিলেন ব্যাংকের বাধ্যবাধকতার কথা। স্যার, আমাদের কিছু করার নেই। আমরা নিয়মের অধীন। এসব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান। অবশ্যই পালন করতে হবে। নইলে ‘দ-ি’ দিতে হবে ব্যাংক অফিসারদের। শেষ পর্যায়ে এসে নতুন গ্রাহক ক্ষেপে গেল লাল আরেক ফরম দেখে। ফরমের নাম ‘ফাটকার অধীনে তথ্য’। ‘ফাটকা’ মানে ‘ফরেন এ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কম্প্লায়েন্স এ্যাক্ট’। এটি একটি মার্কিনী আইন। সেই আইনে আমরা বাংলাদেশ বাঁধা পড়েছি। ফলে এখন সকল হিসাবধারীকে একটি নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হবে। এটি দেখেই ভদ্রলোক ক্ষেপে লাল। তিনি অফিসারকে বললেন, আমি এই ফরম পূরণ করব না। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ আমেরিকা যায়নি। আমি, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কেউ আমেরিকা যাইনি। যাওয়ার কোন অভিলাষ নেই। আমি কেন ফরম পূরণ করে বলব যে, আমি মার্কিন নাগরিক নই, আমি মার্কিন দেশের রেসিডেন্ট নই। কেন বলব আমার যুক্তরাষ্ট্রের কোন স্থায়ী রেসিডেন্ট কার্ড নেই অর্থাৎ গ্রিন কার্ড নেই। কেন আমি বলব যে, আমার যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আমার টিআইএন নম্বর কত, সোস্যাল সিকিউরিটি নম্বর কতÑ এসব অহেতুক আমার আছে কী-না তা কেন বলব। বলাবাহুল্য যে, ফরমটি পূরণ না করলে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ওপেন করবে না তার মধ্যে এসব ঘোষণা করার ব্যবস্থা আছে। দেশে যত ব্যাংক আছে, যত এ্যাকাউন্ট হোল্ডার আছে সবাইকে নাকি এই ফরম পূরণ করে ঘোষণা দিতে হবে আবশ্যিকভাবে। না দিলে যদি কোনদিন প্রমাণ হয় যে, ঐ এ্যাকাউন্ট হোল্ডার মার্কিন নাগরিক তাহলে তার জেল-জরিমানা হবে। এসব কথা ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করতে করতে নতুন গ্রাহক ভদ্রলোক ব্যাংকে প্রায় একটা হৈ চৈ অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেন। সবাই তাঁর কথা শুনছে। কেউ বলেননি যে তাঁর কথাগুলো অযৌক্তিক। আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে একটা ফরম সংগ্রহ করি। বাড়িতে এসে তা স্টাডি করি। পড়লাম, বার বার পড়লাম। অথচ এর মর্মার্থ কিছুই বুঝলাম না। দেশে লাখ লাখ, কোটি কোটি এ্যাকাউন্ট হোল্ডার। সবাইকে এই ফরম পূরণ করতে হবে। বুঝলাম আমাকেও তা করতে হবে। কিন্তু কেন? কোটি কোটি এ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মধ্যে কয়জনের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে কয়জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, কয়জন গ্রীন কার্ড হোল্ডার, কয়জন ওই দেশের রেসিডেন্ট? অথচ যে মার্কিন আইনের সঙ্গে বাংলাদেশকে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে তার ফল ভোগ করবে সবাই। অবশ্যই এটা মার্কিন স্বার্থরক্ষার বিষয়। তা তাদের জন্য ন্যায্য কাজ। তাদের দেশের কোন নাগরিক যাতে তাদের কোন ব্যবসা, কোন আয়, কোন প্রতিষ্ঠান গোপন না রাখতে পারে তার ব্যবস্থা মার্কিনীরা করতেই পারে। সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু এটা ঢালাওভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা কেন? একথা ঠিক আমাদের সোনার বাংলার বহু লোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, গ্রীন কার্ড হোল্ডার। শুনেছি এটা নাকি আমাদের দেশে গ্রহণযোগ্য। দ্বৈত নাগরিকত্ব জায়েজ। অর্থাৎ বাংলাদেশের একজন নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও গ্রহণ করতে পারে। আমি এই বিষয়টা পুরোপুরি জানি না। জানি না তাদেরকে ঐ ক্ষেত্রে এক দেশের নাগরিকত্ব বর্জন করতে হয় কি-না। সম্ভবত নয়। সেই জন্যই দ্বৈত নাগরিকত্ব। বাংলাদেশীদের অনেকেই ‘গ্রীন কার্ড হোল্ডার’। এরা দুই দেশেই বসবাস করে। অনেককে শুনি বছরে-দুই বছরে মার্কিন দেশে যেতে হয়। কারণ তা না হলে নাকি ‘গ্রীন কার্ডের’ কার্যকারিতা থাকে না। এসব আলোচনা এখন সর্বত্র। বস্তুত এটা এখন সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। তা হোক। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন। একজন যদি দ্বৈত নাগরিক হয় তাহলে মার্কিনীরা তাদের আইন বলে এইসব নাগরিকের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতেই পারে। তাদের কোন সম্পদ বাংলাদেশে আছে কি না তাও জানতে চাইতে পারে। আমার প্রশ্ন উল্টো, আমরা কী ঐসব দ্বৈত নাগরিকের কাছ থেকে কর আদায় করি? না কি তারা দ্বৈত নাগরিক বলে রেহাই পেয়ে যায়। বিষয়টা সত্য কথা বলতে কী আমার জানা নেই। কেউ বিষয়টা পরিষ্কার করলে খুশি হব। আমার প্রশ্ন অন্যত্র। ধরা যাক, বাংলাদেশের ১০০ জন নাগরিক মার্কিন দেশেরও নাগরিক বা গ্রীন কার্ড হোল্ডার অথবা সে দেশের রেসিডেন্ট। এক শ’ জন কম বললাম। ধরা যাক এক লাখ লোক। এই এক লাখ লোকের জন্য কোটি কোটি লোককে ‘ফাটকা ফরম’ পূরণে বাধ্য করা কেন? এটা কোন বিচারে? যে শহর বা গ্রামবাসীর কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নেই, তিনি নিজেও কোনদিন যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। তার কাছ থেকে ব্যাংক কেন এই ফরম পূরণ করাবে? ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ লোকের কোন সম্পর্ক নেই মার্কিন দেশের। তাহলে অহেতুক তাদের দিয়ে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে সই করানো কেন? যদি করতে হয় তা করতে হবে মার্কিন নাগরিকদের দিয়ে। যারা গ্রীন কার্ড হোল্ডার, যারা মার্কিন নাগরিক, যারা মার্কিন রেসিডেন্ট তাদের দিয়ে, ‘ফাটকা ফরম’ পূরণ করা যেতেই পারে। অন্যদের দিয়ে কেন? প্রশ্ন, সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিভাবে জানবে কারা মার্কিন নাগরিক, কারা গ্রীন কার্ড হোল্ডার? এর উত্তর সহজ। মার্কিন সরকারের কাছে ঐসব রেকর্ড নিশ্চিতভাবেই আছে। তারা সরকারকে তা দিয়ে দিলেই তো হয়। সেই তালিকায় যারা থাকবে তারা এ্যাকাউন্ট ওপেনিংয়ের সময় ‘ফাটকা ফরম’ পূরণ করবে। এ তো খুব সহজ কথা। এই বিকল্প থাকতে ব্যাংকগুলো কেন কোটি কোটি এ্যাকাউন্ট হোল্ডারের কাছ থেকে এই ফরম পূরণ করাচ্ছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। বোঝা যাচ্ছে, আমরা স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে ‘ফাটকা’ আইনে ধরা দিয়েছি। তাহলে তো আশঙ্কা করতেই পারি দুদিন পর আরেক প্রভাবশালী দেশ আমাদের দিয়ে আরেকটা আইনে সই করিয়ে নিতে পারে। তখন হয়ত আরেকটা ফরম পূরণ করে বাংলাদেশের ব্যাংকের কোটি কোটি গ্রাহককে ঘোষণা করতে হবে যে আমরা যুক্তরাজ্যের, কানাডার, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক নই। এই আশঙ্কা যাতে সত্যি না হয় তাই কামনা করি। তবে একটা কথা আছে। যে কোন চুক্তি আমরা জানি উভয় পক্ষে স্বার্থরক্ষা করে। একপক্ষীয় স্বার্থ দিয়ে কোন চুক্তি হয় না। যদি তাই হয় তাহলে ‘ফাটকা’ আইনের বলে যে চুক্তি হয়েছে তাতে কি আমাদের স্বার্থ রক্ষিত রয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের করের আওতায় আনার জন্য কঠোর হচ্ছে। তার নাগরিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। তারা কর ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, তারা বিদেশে সম্পদ করছে কিনা তা জানতে চায়। এটা তার অধিকার এবং মার্কিন সরকারের দায়িত্বও বটে। একই দায়িত্ব তো আমাদের সরকারের আছে। অতএব প্রশ্ন ‘ফাটকা’ আইন বলে যে চুক্তি হয়েছে তার অধীনে আমরা কী জানতে পারি আমাদের নাগরিকদের কোন ব্যাংক হিসাব মার্কিন দেশে আছে কিনা, আমরা কী জানতে চাইতে পারি আমাদের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে কোন সহায়-সম্পদ আছে কিনা? কেন্দ্রীয় ব্যাংক দয়া করে বিষয়টি পরিষ্কার করবে আশা করি। ‘ফাটকা’ বা ফরেন এ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স এ্যাক্ট থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। অভিযোগ আমাদের দেশের লাখ লাখ নাগরিক নানা দেশের অভিবাসী। কেউ বৈধভাবে, কেউ অবৈধভাবে। এখানে দ্বৈত নাগরিকত্বের ইস্যুও আছে। যেভাবেই হোক না কেন এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত আছে। যারা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নিয়ে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে তাদের হিসাব আমরা চাইতে পারি। আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ না করে যারা বিদেশেরও নাগরিকত্ব নিয়েছে তাদের তথ্যও আমরা নিতে পারি। কর আদায় এখানে একটা ইস্যু। দ্বিতীয়ত সম্পদ। সম্পদ পাচারের অভিযোগ আমাদের দেশে বড় একটি অভিযোগ। মালয়েশিয়া, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, ইদানীংকালে রেঙ্গুন, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় সম্পদ পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ। অনেক দ্বীপ দেশেও সম্পদ পাচার হচ্ছে। মার্কিনীদের ‘ফাটকা’র আদলে কী কী করা যায় সে ব্যাপারে সরকারকে ভাবতে হবে। সমস্ত বিষয়টাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা দরকার, দরকার ইউনিফরমিটি। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×