ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উভয়কুল রক্ষার চেষ্টা মিন্টুর, বেগম জিয়া ক্ষুব্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ এপ্রিল ২০১৫

উভয়কুল রক্ষার চেষ্টা মিন্টুর, বেগম জিয়া ক্ষুব্ধ

শরীফুল ইসলাম ॥ এক সময় প্রবল ইচ্ছা থাকলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করতে চাননি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু। তবে তিনি খালেদা জিয়ার নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারছিলেন না। আবার সরকারী দলের শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে নির্বাচন না করতে তার ওপর চাপ ছিল। তাই উভয়কুল রক্ষা করতে মনোনয়নপত্র পূরণ করতে গিয়ে ‘ইচ্ছাকৃত’ ভুল করেছেন মিন্টু। মিন্টুর এ ভূমিকায় চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এদিকে মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাদ পড়ায় বিএনপির সমর্থন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী। আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণার বিষয়টি ঝুলে গেছে। বৃহস্পতিবার আবদুল আউয়াল মিন্টুর পক্ষ থেকে লোক দেখানো আপীল করা হলেও এ আপীল যে টিকবে না তা খোদ বিএনপি নেতাকর্মীরাই বলাবলি করছেন। তবুও বিষয়টি ফয়সালা হওয়ার পর বিএনপি দলের বাইরে থাকা সুবিধাজনক কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেবে। তবে আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল বিএনপির সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস -চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আপত্তি না থাকলে দল থেকে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকেই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে সমর্থন দেয়া হবে। অবশ্য মাহী বি চৌধুরী ইতোমধ্যেই সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে এখানে বিএনপির অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ও নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল বাশার এখনও প্রার্থী থাকলেও ৯ এপ্রিলের মধ্যেই তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আগেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মনজুর আলমকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। জানা যায়, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। এ জন্যই পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা না করলেও তিনি আত্মগোপনেই থেকে যান। তবে খালেদা জিয়া তাকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন করার কথা বললে তিনি সরাসরি তা নাকচ না করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহ অথবা যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলুর নাম প্রস্তাব করে তাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দিলে ভাল হবে বলে জানান। কিন্তু খালেদা জিয়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের জন্য দলীয় অন্য কারো নাম আমলে না নিয়ে মিন্টুকেই নির্বাচন করতে বলেন। লন্ডনপ্রবাসী বিএনপির সিনিয়র ভাইস -চেয়ারম্যান তারেক রহমানও খালেদা জিয়ার এ সিদ্ধান্তের প্রতি সায় দেন। এর পর আর নির্বাচন করার ব্যাপারে না বলতে পারেননি মিন্টু। তবে কি করে উভয়কুল রক্ষা করা যায় সে কৌশল খুঁজতে থাকেন তিনি। অবশেষে তার মনোনয়নপত্রে আব্দুর রাজ্জাক নামক এক লোককে সমর্থক হিসেবে দেখানো হয়, যিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ভোটার নন। সূত্র মতে, নিজের মনোনয়নপত্র বতিল হয়ে যাবে নিশ্চিত হয়েই আবদুল আউয়াল মিন্টু শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মেয়র পদে তার ছেলে তাবিথ আউয়ালের নামে মনোনয়নপত্র দাখিল করান। তার অনুপস্থিতিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সমর্থন নিয়ে যাতে ছেলেকে মেয়র নির্বাচিত করা যায়। আর ছেলে মেয়র নির্বাচিত না হলেও যাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে আলোচনায় থাকতে পারে এটাই ছিল মিন্টুর কৌশল। তার সে কৌশল সফল হবে যদি বিএনপি তার ছেলেকে সমর্থন দেয়। তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির সমর্থন পেতে ইতোমধ্যেই বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব ও বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ মাহী বি চৌধুরী দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি নিজে এবং তার বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমানে বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এ বিষয়ে বিএনপির কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের বেশিরভাগই মাহীকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস -চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মাহী বি চৌধুরীর দীর্ঘদিনের বিরোধ থাকায় এ বিষয়ে তারেক রহমান আপত্তি দেয় কিনা তা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যে জল্পনাকল্পনা চলছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় ঠেকাতে তারেক রহমানসহ বিএনপির সব নেতাই বাস্তবতার নিরিখে মাহীকেই ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে সমর্থন দিতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য লোক দেখানো চেষ্টার অংশ হিসেবে বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্র বৈধ করার বিষয়ে বৃহস্পতিবারই আপীল করেছেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। এদিকে কেন আবদুল আউয়াল মিন্টু তার মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে এমন সহজ জিনিসটি ভুল করলেন এবং বিএনপিকে বিপদে ফেললেন তা নিয়ে সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা চলছে। অনেকেই বলছেন, মিন্টু নির্বাচন করবেন না বলে পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ইচ্ছা করেই মনোনয়নপত্রে ভুল করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, যিনি এই সহজ জিনিসটি ভুল করেন তিনি কিভাবে মেয়র হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। দেশব্যাপী এ ধরনের জল্পনাকল্পনা চলতে থাকায় বিএনপি হাইকমান্ডও বিব্রত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভুল তো ভুলই। কেন এমন সহজ ভুলটি মিন্টু সাহেব করলেন তা তিনিই বলতে পারবেন। তবে নির্বাচন কমিশন লঘু ভুলে গুরু দ- দিয়েছেন। তার মনোনয়নপত্রটি বাতিল না করলেই পারতেন। আর মিন্টু সাহেব বাদ হলেও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে তার ছেলে তাবিথ এবং বিকল্প ধারার মাহী বি চৌধুরী আছে। চিন্তাভাবনা করে এই সিটিতে একজন যোগ্য প্রার্থীকেই সমর্থন দেবে বিএনপি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতেও আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা করতে আরও সময় লাগবে। প্রসঙ্গত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলম বুধবার মিন্টুর ছেলেসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতেই তার মনোনয়নপত্র বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আবদুল আউয়াল মিন্টুর সমর্থক আব্দুর রাজ্জাক উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ সময় মিন্টুর ছেলে তাফসির আউয়াল বলেন, এ বিষয়ে আপীল করা হবে। তার কথামতে, বৃহস্পতিবার আপীল করা হয়েছে। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে কারণে মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে তা আপীল করলেও টিকবে না। বিএনপি নেতাকর্মীর কেউ কেউ বলাবলি করছেন, এক সময় প্রবল ইচ্ছা থাকলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবদুল আউয়াল মিন্টু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করতে ইচ্ছুক নন। কারণ, বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও দলের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক হলেও দলীয় কর্মকা-ে তেমন সক্রিয় নন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখাসাক্ষাত ও দলের জন্য কিছু ডোনেশন সংগ্রহ ছাড়া আর কোন কর্মকা-ে তিনি খুব একটা অংশ নেন না। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখনও সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তিনি চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। সরকারী দলের নেতাদের সঙ্গে তার আত্মীয়তাও রয়েছে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, তিন সিটি কর্পোরেশনের তফসিল ঘোষণার পরই সরকারী দলের শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে আবদুল আউয়াল মিন্টুকে নির্বাচন না করার পরামর্শ দেয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী ব্যবসায়ী আনিসুল হক মিন্টুর নিজ এলাকা নোয়াখালীর অধিবাসী হওয়ায় সেদিক থেকেও মিন্টুকে নির্বাচনের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। আর এসব বিষয় মাথায় রেখেই মিন্টু নির্বাচন করার ব্যাপারে আগ্রহ হারান। তবে খালেদা জিয়া তাকে নির্বাচন করার জন্য বার বার বলতে থাকায় তিনি মনে মনে একটি কৌশল আঁটেন। আর নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে এ কৌশলের অংশ হিসেবেই তিনি তার মনোনয়নপত্রে ইচ্ছা করেই ভুল করেন। অবশ্য তার ছেলে তাফসির আউয়াল সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, তার বাবার নামে থাকা বিভিন্ন মামলার বিষয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় মনোনয়নপত্র পূরণের ক্ষেত্রে ভুলটি কারও নজরে আসেনি। তবে মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের মনোনয়নপত্রটি কেন ভুল হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুই বলেননি। বিএনপি সংশ্লিষ্ট অপর এক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অবিভক্ত থাকা অবস্থায় আবদুল আউয়াল মিন্টুর মেয়র পদে নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ ছিল। তখন সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি নিজের লোক দিয়ে গবেষণাও চালিয়েছিলেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরকে আরও আধুনিক করতে কি কি করা যায় সে বিষয়ে লিফলেটও বিতরণ করেছিলেন। কিন্তু ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া বিএনপি আন্দোলন শুরুর পর নতুন করে ক’টি মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। একবার গ্রেফতার হয়েও সরকারী দলের নেতাদের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান। এ ছাড়া সরকারী দলের শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শেই এক পর্যায়ে তিনি আত্মগোপনে যান। তাই এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচন করলে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে ভেবে তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্দেশের পরও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন করতে চাননি। আর এ কারণেই ইচ্ছা করে মনোনয়নপত্রে ভুল করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির এক নেতা বলেন, সবাই জানত আবদুল আউয়াল মিন্টু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলের প্রার্থী। এ কারণে দলের অন্য কোন নেতা এই সিটিতে মেয়র পদে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কেনেননি। যদি জানত মিন্টু নির্বাচন করতে চান না তাহলে প্রার্থী হওয়ার মতো আরও অনেক যোগ্য নেতা ছিল। মিন্টুর ভুলের জন্য এখন দলকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে। তবে দলীয় হাইকমান্ডের উচিত হবে মিন্টুর এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া। সেই সঙ্গে কেন মিন্টু এমন সহজ জিনিসটি ভুল করল, না ইচ্ছা করেই এমনটি করল তাকে তলব করে দলের স্বার্থে জিজ্ঞেস করা উচিত। জানা যায়, মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বুধবার রাতেই খালেদা জিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কি কারণে এমনটি হলো তা অনুসন্ধান করতে তিনি দলের কয়েক নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া লন্ডন থেকে এ খবর পেয়ে তারেক রহমানও তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছেন বলে জানা গেছে।
×