ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উইপোকায় কেটেছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের দুর্লভ বই

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৪ এপ্রিল ২০১৫

উইপোকায় কেটেছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের দুর্লভ বই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অবহেলা, অব্যবস্থাপনার কারণে উইপোকায় কেটে ধ্বংস করে ফেলেছে শিক্ষা ভবনের বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার এবং লাইব্রেরির অসংখ্য দুর্লভ বই। বছরের অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার বন্ধ রাখার পর এবার সেখানে রাখা দুর্লভ বই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে পুরো শিক্ষা প্রশাসনে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের মতো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে মাউশি কর্তৃপক্ষের এ অবহেলার ঘটনায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মাঝে। এদিকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্যরা প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, অযত্ন, অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। বছরের অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার বন্ধ ছিল বলেও হতাশা প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। গত চার দিন ধরে তদন্ত কমিটির সকল সদস্য ঘটনাস্থলে কাজ করছেন। তাঁরা উইপোকার কাটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বইগুলো আলাদা করেছেন। পুরোপুরি নষ্ট হওয়া অনেক বই ডাস্টবিনেও ফেলে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। পোকার আক্রমণে নষ্ট হওয়া বুকসেলফগুলো বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্নারের ভেতরেই কথা হচ্ছিল কমিটির দু’সদস্যের সঙ্গে। দুই সদস্য সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল খালেক ও মাউশির লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ মজনুর রহমান নষ্ট হওয়া বই পরিষ্কার করতে করতে বলছিলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সদস্য হিসেবে আমরা কাজও শুরু করেছি। বেশ কিছু বই উইপোকায় কেটে ফেলেছে। অনেক বই কিছুটা কেটেছে। বুক সেলফও নষ্ট হয়েছে। কিন্তু গত ডিসেম্বরেও কর্নার বন্ধ রাখা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। তার পরেও কেন মাউশি কর্তৃপক্ষ নজর দেয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে এ দুই কর্মকর্তা কোন উত্তর দিতে রাজি হননি। তবে এখন এ অবস্থার কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, আসলে কি অধিকাংশ সময় তো বন্ধই ছিল। ফলে ভেতরের অবস্থাও বোঝা যায়নি। খোলা থাকলে এমন হতো না। অব্যবস্থাপনার কারণেই এটা হয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ১৮ দিনের সফরে দেশের বাইরে আছেন। আগামী ১৮ এপ্রিল দেশে ফিরবেন। তাঁর আসার আগে বিষয়টির ভাল কোন সুরাহা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান অধিদফতরের কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে শিক্ষা ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর দেশী-বিদেশী লেখকদের বই ছাড়াও ভাষা, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের দুর্লভ বইগুলোরও একই দশা। শিক্ষাভবনের উত্তর গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার এবং লাইব্রেরি। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, পাঁচটি বস্তা এবং একটি বিশাল আকারের ডালিতে উইপোকায় খাওয়া বইগুলো রাখা আছে। যার একটিও পড়ার উপযোগী নেই। কোন রকম দেখে দেখে সেই বইগুলোর লেখক, প্রকাশক এবং বইয়ের নাম একটি সাদা কাগজে তালিকাবদ্ধ করা হচ্ছে। এসব বইয়ের মূল্য সম্পর্কে মাউশির কর্মকর্তারা বলেছেন, এখানে শতাধিক বই নষ্ট হয়েছে। টাকার মূল্যে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা হলেও কোটি টাকায়ও হয়ত এখন এর অনেক বই পাওয়া যাবে না। বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, বইগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ। ১০ আলমারির মধ্যে প্রথম দফায় চেক করা তিনটি আলমারির একটিরও বই ভাল নেই। ওই তিনটি আলমারি লাইব্রেরির সামনের বারান্দায় দেখা যায়। শুধু বই নয়, আলমারির তাকগুলোও খেয়ে ফেলেছে উইপোকা। যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে আলমারিগুলো। জানা গেল, নষ্ট হওয়া বইয়ের মধ্যে রয়েছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া কয়েকটি ঐতিহাসিক ভাষণের (৭ মার্চসহ) ওপর লেখা বই, ছবিসহ পোস্টার। আছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রায় শ’খানেক বই। মুক্তিযুদ্ধের দলিল (১৫ খ-), বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ছবি সংবলিত পোস্টার, সেক্টর কমান্ডারদের ছবিসহ পোস্টার এবং দেশী-বিদেশী লেখকদের লেখাসহ ভাষা, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই। মাউশির পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, যাঁরা দায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উইপোকায় যেসব বই নষ্ট করেছে সেগুলোর একটি তালিকা করছি। কি পরিমাণ বই নষ্ট হয়েছে তার তালিকা দ্রুতই পাওয়া যাবে। এদিকে জানা গেছে, গত আড়াই বছর ধরে এটি প্রায় বন্ধই ছিল। অবস্থা এমন যে, ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদের বিশেষ উদ্যোগে কর্নার প্রতিষ্ঠা হলেও বন্ধ থাকায় দর্শনার্থীরা সেখানে যেতে পারেননি। অথচ শিক্ষা ভবনে প্রতিদিন আসেন সারাদেশের শত শত শিক্ষক-কর্মচারী। দুই বছরে দর্শনার্থীর প্রবেশের করুণ চিত্রের প্রমাণ মেলে পরির্দশন খাতার স্বাক্ষর দেখলেও। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে প্রবেশ করে দেখা যায়, দুই বছরে খাতায় স্বাক্ষর আছে মাত্র ২০ জনের। যার মধ্যে আবার উদ্বোধন করার দিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর স্বাক্ষর আছে। এছাড়া আছে শিক্ষা অধিদফতরের হাতে গোনা কয়েক জনের সাক্ষর। প্রগতিশীল শিক্ষক-কর্মচারীরা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসনে বিশেষ করে শিক্ষা অধিদফতরে বিএনপি-জামায়াতের দাপটের কবলে পড়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। এই চক্র মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনকেও অন্ধকারে রেখে একের পর এক অপকর্ম করিয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর কর্নার উদ্বোধনের দিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অনেক আশা নিয়েই লিখেছিলেন, ‘মাউশিতে বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপনের মধ্যদিয়ে এখানে আমাদের গৌরবের ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি ভা-ার গড়ে তোলার যাত্রা শুরু হলো। আজকের অনুষ্ঠান চমৎকার হয়েছে। ডিজিসহ সংশিষ্ট সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’ মাউশির সাবেক সফল মহাপরিচালক অধ্যাপক মোঃ নোমান উর রশীদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই দেশ পেয়েছি। আওয়ামীল লীগ ক্ষমতায় বলেই আমরা ডিজি ও কোষাধ্যক্ষ হতে পেরেছি। যদি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগকে তালাবন্ধ করে রাখি তবে আমরাও ইতিহাসে তালাবদ্ধ থাকব। কেউ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন না।
×