ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

অভিমত ॥ ইলিশ উৎসব ও একটি প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৫ এপ্রিল ২০১৫

অভিমত ॥ ইলিশ উৎসব ও একটি প্রস্তাব

আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। স্বাদের দিক দিয়ে পৃথিবীর ভোজনরসিক মানুষদের জন্য লোভনীয় একটি নাম। পৃথিবীর নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের কাছে রয়েছে আমাদের ইলিশের বিশেষ কদর। ভিনদেশী যাঁরাই বাংলাদেশে আসেন না কেন, ইলিশের স্বাদবিহীন তারা প্রস্থান করেন না। ইলিশের গন্ধ নেয়া যেন এদেশে সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর ভোজনবিলাসী বাঙালীর ইলিশের কথা বললেই প্রথমে উঠে আসে চাঁদপুরের নাম। আসে পদ্মা নদীর ইলিশের কথা। এ কথা কে না জানেন- চাঁদপুরের ইলিশের স্বাদ, গন্ধ জগতজোড়া। আলাদাভাবে বললে ভোজনরসিকদের প্রথম পছন্দ চাঁদপুরের ইলিশ। তাই এখানকার ইলিশ দেশের নানা প্রান্তে চলে যায়। অনেক প্রাজ্ঞজনই বলে থাকেন- ইলিশ চাঁদপুরের হলেও বিশ্বজোড়া তার খ্যাতি, ইলিশ বৈশ্বিক সম্পদ। আবহমান বাঙালীর সংস্কৃতি, উৎসব, পহেলা বৈশাখ- সবকিছুতেই ইলিশ অনবদ্য নাম। ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করে, আবিষ্ট করে রাখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, সেসব দেশের যা বিখ্যাত, যা ঐতিহ্য তাকে ঘিরেই সরকারীভাবে ‘উৎসব’-এর আয়োজন করা হয়। এমনকি আমাদের দেশেও আমের জন্য খ্যাত রাজশাহীতে প্রতিবছর আয়োজিত হয় ‘আম উৎসব’। ইলিশ আমার জাতীয় মাছ, খাদ্যগুণে অনন্য, স্বাদে বিচিত্র- এই ইলিশকে ঘিরেই চাঁদপুরে গত ছয় বছর একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে আয়োজন করা হয় ইলিশ উৎসবের। ইলিশ উৎসবের মূল লক্ষ্য জাতীয় মাছ ইলিশ সংরক্ষণে জেলেদের ও ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং দেশীয় ঐতিহ্যের বিকাশ লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। ২০১৪ সালে ষষ্ঠবারের মতো এই ইলিশ উৎসব আয়োজিত হয়েছিল সাত দিনব্যাপী। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় বেসরকারীভাবে হলেও ২০০৯ সাল থেকে দর্শকরা ইলিশ উৎসবকে তাদের প্রাণের উৎসব হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রতিদিনই আয়োজনস্থলে ঢল নেমেছে শত শত মানুষের। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হলো এই যে, এত বৃহৎ পরিসরে ইলিশ উৎসবের আয়োজনে অর্থনৈতিক বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় একটি সংগঠনের পক্ষে এমন একটি আয়োজন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, বিশেষত অর্থের যোগানের দিক দিয়ে। স্পন্সর সংগ্রহ করে চালিয়ে নেয়া হয় অনুষ্ঠানের খরচের একাংশ। কিন্তু অনুষ্ঠানটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে যে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুলই বলা চলে। তাই উৎসবটি যদি জাতীয়ভাবে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা হয় তবে এ উৎসব হবে দেশের সংস্কৃতি ও উৎসবের নব সংযোজন, লোকজ উৎসব। ইলিশ উৎসবকে যদি জাতীয় উৎসবে রূপ দেয়া হয়, তবে একদিকে যেমন আমাদের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবে, বিনোদনের সুস্থ ধারা অব্যাহত থাকবে, অন্যদিকে জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে জাটকা নিধন বন্ধের মাধ্যমে ইলিশ সম্পদ রক্ষা পাবে। বর্তমানে জাটকা ইলিশ নিধনের মাধ্যমে দেশের ইলিশ সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। জাটকা নিধন বন্ধ করার জন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। নদীতে অভয়াশ্রমের সময় জেলেদের খাদ্য সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই জাটকা নিধন। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে জেলেরা জাটকা নিধন থেকে বিরত থাকবে। রক্ষা পাবে বিপুল পরিমাণ ইলিশ সম্পদ। এও সত্য যে, বিনোদন অনুষ্ঠান সচেতনতা বৃদ্ধির খুবই শক্তিশালী হাতিয়ার, একে উপেক্ষা করা যায় না। যদি চাঁদপুরে জাতীয় ইলিশ উৎসব করা যায়, তবে এ উৎসবের আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে বিনোদনের মাধ্যমে জাটকা নিধনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি সহজসাধ্য হবে। এই ইলিশ উৎসবকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিতে চাঁদপুরবাসীর দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি চাঁদপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বস্তরের মানুষের। এ উৎসবটি চাঁদপুর ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, চাঁদপুরে মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট রয়েছে এবং চাঁদপুরেই ইলিশের সর্ববৃহৎ প্রজনন ও বিপণন কেন্দ্র তাই মৌসুমী এই উৎসবটিকে একটি জাতীয় উৎসবে রূপ দেয়ার প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে চাঁদপুরবাসীর পক্ষ থেকে। আমরা মনে করি, যদি চাঁদপুরে জাতীয় ইলিশ উৎসব করা যায়, তবে এ উৎসবের ব্যাপকতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রতিটি জেলায়, সীমানা ডিঙ্গিয়ে এর কদর বাড়বে বহির্বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতেও। এতে সরকার বৈদেশিক রফতানিতে ইলিশ সম্পদের যথাযথ সুফল পাবে। দেশীয় ঐতিহ্য ইলিশ সম্পদ সুরক্ষায় সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; ইলিশ হয়ে উঠুক ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন এই প্রত্যাশা সবার।
×