ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৯২ দিন পর গুলশান কার্যালয় থেকে বের হচ্ছেন ;###;হাজিরা দেবেন আদালতে ;###;আদালত এলাকায় কর্মীদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ

খালেদা বাড়ি ফিরছেন!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ এপ্রিল ২০১৫

খালেদা বাড়ি ফিরছেন!

শরীফুল ইসলাম ॥ অবশেষে দীর্ঘ ৯২দিন পর গুলশান কার্যালয় থেকে বের হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে আজ রবিবার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ জজ আদালতে যাচ্ছেন তিনি। এ জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। শনিবার খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও খালেদা জিয়া আদালতে যাবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং পরে গুলশানের বাসায়ও ফিরে যেতে পারেন। গুমোট রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে দলীয় কর্মকা- চাঙ্গা করতে তিনি এ কৌশল নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশে কোন বাধা না থাকলেও শনিবারের আগে সেখানে কেউ প্রবেশ করেননি। তবে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দলের সহ-দফতর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীনের নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী সেখানে যান। পরে আরও কয়েক সিনিয়র নেতা ওই কার্যালয়ে যান। কেন্দ্রীয় কার্যলয়ের সামনে এখন পুলিশের সর্বক্ষণিক প্রহরাও নেই। আজ আদালতে গিয়ে জামিন পেলে দলের অন্য নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও সেখানে যেতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘সিএসএফ’ টিমকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া আদালতে যাওয়া-আসার পথে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের রাস্তায় বিশেষ করে আলিয়া মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এর ফলে এতদিন আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই আজ বের হয়ে আসবেন বলে জানা গেছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৮ সালের ৩ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ কয়েকজনের নামে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ লুটপাটের অভিযোগে মামলা হয়। এর পর ষাটের অধিকবার মামলার শুনানির তারিখ পড়লেও খালেদা জিয়া আদালতে যান মাত্র ৭বার। সর্বশেষ গত বছর ২৪ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ আদালতে হাজিরা দিতে যান। গত বছর ১৯ মার্চ এ দুটি মামলায় অভিযোগ গঠনের পরও কয়েক দফা সাক্ষ্য গ্রহণও পিছিয়েছে। তবে বিচারক এ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। যদিও এখনও সংশ্লিষ্ট থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পৌঁছেনি। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই আজ হাজিরা দিতে বকশিবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ আদালতে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে ৪ মার্চ খালেদা জিয়ার পক্ষে তার আইনজীবীরা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন জানালে খালেদা জিয়ার এই পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন নাকচ কওে ৫ এপ্রিল শুনানির দিন ঠিক করে দেন বিশেষ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। বর্তমানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান শনিবার সাংবাদিকদের জানান, রবিবার খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা নির্ভর করছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর। এর আগে বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পেলে খালেদা জিয়া আদালতে যাবেন। তাই সরকারের দায়িত্ব হবে তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া। খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাকে যেন আবার গুলশান কার্যালয়ে ফিরে যেতে দেয়া হয় সে নিশ্চয়তাও চান খন্দকার মাহবুব হোসেন। সূত্র মতে, আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে জামিন পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক রায় এলে আলিয়া মাদ্রাসার বিশেষ আদালত থেকে বের হয়ে প্রথমে খালেদা জিয়া দলের অন্যান্য নেতাকর্মীকে নিয়ে নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে পারেন। কার্যালয়ে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত না হলে তিনি সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করতে পারেন। আর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে গুলশান কার্যালয়ে ফিরে যাবেন। সেখানেও যদি প্রবেশে বাধা দেয়া হয় তাহলে তিনি গুলশানের বাসায় ফিরে যাবেন। অবশ্য গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়া না হলেও আদালত থেকে ফেরার পথে অথবা রাতে দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে খালেদা জিয়ার আজ বাসায় ফিরে যাবার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানা গেছে। চলমান আন্দোলন কর্মসূচীতে সফলতা না এলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হবেন না; এতদিন এমন অবস্থানেই অনড় ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ অবস্থানের কারণে ঘরে-বাইরে নানামুখী চাপের সম্মুখীন হন তিনি। আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় সরকারের তরফ থেকেও তাকে গ্রেফতার করার কথা বলা হয়। আর আসন্ন ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলেও দলের নেতাকর্মীরা বর্তমান পরিস্থিতির কারণে নির্ভয়ে প্রচারে অংশ নিতে পারছেন না। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। সরকার যদি কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসে তাহলে কিছুদিন দেখে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী থেকে সরে আসবেন। তবে বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান থেকে সরে না এলে আবার খালেদা জিয়া কঠোর আন্দোলনের পথেই যাবেন। প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে এ কর্মসূচী সফল করতে ২দিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। এখান থেকেই তিনি ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এর আগে থেকেই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করতে থাকেন। ৩ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকালে খালেদা জিয়া জানতে পারেন নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত রুহুল কবির রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন খালেদা জিয়া রিজভীকে দেখতে গুলশান কার্যালয় যেতে চান। কিন্তু খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির কর্মসূচীকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে যাবেন এমন আভাস পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং তাকে সেখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে বাধা দেয়। সেই সঙ্গে রাতেই রিজভীকে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরদিন ৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুইপাশে ব্যারিকেড দিয়ে র‌্যাব-পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য সেখানে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার বাসা সংলগ্ন ৮৬ নম্বর সড়কের দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ১২টি ইট, বালি ও মাটিভর্তি ট্রাক, ২টি প্রিজনভ্যান ও ১টি সাঁজোয়া যান ও ১টি জলকামান কার্যালয়টি অবরুদ্ধ করা হয়। ৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। গাড়িতে চড়ে বসলেও পুলিশ গেট খুলে না দেয়ায় গুলশান কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেটে লাথি মেরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে ছুড়ে মারে। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সারা দেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। আজ রবিবার টানা অবরোধ কর্মসূচীর ৮৯তম দিন অতিবাহিত হচ্ছে। অবশ্য ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই সরাদেশে হরতালও পালন করেছে বিএনপি জোট। তবে স্বাধীনতা দিবসের আগে-পরে কয়েকদিন হরতাল পালন না করলেও গত সপ্তাহ থেকে আবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাড়া সারা দেশে হরতাল পালন করছে তারা। যদিও এ হরতাল-অবরোধে খোদ বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরাই মাঠে নামে না। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশে একটি বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়। অন্যদিকে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়। দুই মামলারই বাদী হলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি ছয়জন। ইতোমধ্যেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক। অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আসামি চারজন। খালেদা ছাড়া অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম।
×