ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুত বিতরণে মান বাড়ছে না, যদিও সরবরাহ পর্যাপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৬ এপ্রিল ২০১৫

 বিদ্যুত বিতরণে মান বাড়ছে না, যদিও সরবরাহ পর্যাপ্ত

রশিদ মামুন ॥ উৎপাদনে উন্নতি হলেও বিদ্যুত বিতরণে সেবার মান বাড়ছে না। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতে যেমন বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে গ্রাহককে তেমনি কারিগরি ত্রুটি পিছু ছাড়ছে না। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও বিদ্যুত বিচ্ছিন্নতাকে গ্রাহক লোডশেডিং মনে করছেন। বার বার একই অবস্থার সৃষ্টি হলেও সংশ্লিষ্টরা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সকল ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বিশ্বমানের বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে কারণে অকারণে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হতে না হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের কোন বিতরণ কোম্পানির সেবার মান বিশ্বমানের নয়। পুরাতন, ত্রুটিযুক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে অনেকটা খুঁড়িয়ে চলছে সারাদেশের বিদ্যুতের বিতরণ। খোদ রাজধানী ঢাকার দুই বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতেও (ডেসকো) এই সমস্যা প্রকট। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন রাজধানীবাসী। আবার ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়িতে প্রায়সই বিপত্তি ঘটছে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার। দেশের বৃহত্তর এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) তে এই সমস্যা সব থেকে প্রকট। দেশের সব পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকের এই অবস্থা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিতরণ ব্যবস্থায়ও যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। বলা হচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)-এর সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার লাইন অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। এতে ঘটছে বিপত্ত। গত পহেলা নবেম্বর সারাদেশে ব্লাক আউটের পরও মাঝে মধ্যেই কোন না কোন ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আশুগঞ্জ পায়ার স্টেশনে দুই দফা বিপর্যয় দেখা দেয়। রাজশাহীর কাটাখালি সাবস্টেশনে ত্রুটির কারণে গোটা রাজশাহী বিদ্যুতবিহীন হয়ে যায়, এমনকি শনিবার বিকেলে ঝড়ের কারণে রবিবারও রাজশাহীর সকল উপজেলা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার মানিকনগর এবং উলন সাবস্টেশনে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয় গত দুই সপ্তাহে। সবশেষ গত শনিবার পিজিসিবি সিদ্ধিরগঞ্জ সাব স্টেশনে কারিগরি ত্রুটির কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে অবশ্য বিকল্প পন্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়। সরবরাহ ব্যবস্থায় নজরদারি না বাড়ালে গ্রীষ্মে বড় সঙ্কটে পড়তে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেবার মান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বার বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলেও এখনও পর্যন্ত তা বাড়েনি। সরকার বিদ্যুত উৎপাদনে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। অন্যদিকে বিতরণ কোম্পানির প্রত্যেকটি লাভ করছে। অর্থাৎ গ্রাহক তার সেবার জন্য যে মূল্য পরিশোধ করছে তাতে বিতরণ কোম্পানি সকল ব্যয় নির্বাহ করে অতিরিক্ত অর্থ জমা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও সেবার মান কেন বাড়ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিতে থাকলে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলতে পারত সেবার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় কিন্তু লাভজন কোন কোম্পানির এ ধরনের দোহায় অগ্রহণযোগ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে দেশের বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার একটি বড় অংশই ওভার লোডে চলছে বছরের পর বছর। বিদ্যুত বিতরণে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা না থাকায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আর এখন উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুত সংযোগ বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া হয়েছে এতে লাইনগুলো আরও বেশি ওভার লোডে চলছে। যাতে বিদ্যুত বিভ্রাটের মাত্রা বাড়ছে। বিদ্যুত সূত্র জানায়, এখন আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থায় প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আসে ৪০ বছরের পুরাতন বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে। এছাড়া দেশের গ্রিড এবং সাবস্টেশনের অনেকটাই মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরাতন। এসব বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর তথ্যও দ্রুত পাওয়া যায় না। আবার একবার বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে সংযোজনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পন্থায় লোড নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্ক্যাডা অপারেশন আর মাধ্যমে লোড নিয়ন্ত্রণের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এজন্য ৩৩ কেভি ফিডার লাইনের পাশাপাশি ১৩২ কেভি ফিডার লাইনে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে স্থাপন করতে হবে। পিজিসিবেকে এই রিলে স্থাপন করতে বলা হয়েছে। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি কমতে থাকলে কেন্দ্রীয় লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি) কর্তৃক অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্ক্যাডা অপারেশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। সরকার গঠিত একটি কমিটি বলছে, দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থার ফ্রিকোয়েন্সি ৫০ হার্জ। সাধারণত বিদ্যুত কেন্দ্রর নিরাপত্তায় ফ্রিকোয়েন্সি ৫২ হার্জ থেকে ৪৬ হার্জ রাখা হয়। অন্যদিকে গ্রিড উপকেন্দ্রে ৩৩ কেভি ফিডারে কয়েকটি ধাপে (৪৯ দশমিক ১, ৪৯ দশমিক ০, ৪৮ দশমিক ৯, ৪৮ দশমিক ৮, ৪৮ দশমিক ৭ হার্জ) ফ্রিকোয়েন্সি রয়েছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক পরিচালক (অপারেশন) মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের বিতরণ ব্যবস্থার প্রায় সব লাইনই ওভার লোডে চলছে। ওভার লোড সমস্যা দূর করা সম্ভব না হলে সেবার মান বৃদ্ধি করা যাবে না। তিনি জানান, ডিপিডিসির কিছু সাবস্টেশনে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। গ্রীষ্মের আগেই যা সারিয়ে তুলতে হবে। এছাড়া নজরদারি বৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, আরও ক্লোজ মনিটরিং করতে হবে সকল ক্ষেত্রে। উৎপাদন পর্যায় সম্পর্কে জানা যায়, কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র, ময়মনসিংহর আরপিসিএল, শাহজীবাজার, সিলেট, বাঘাবাড়ি, রংপুর, সৈয়দপুর, ভেড়ামারা, বরিশাল গ্যাস টারবাইন মেশিনগুলোতে ব্লাক স্ট্রাট সুবিধা রয়েছে। কিন্তু গত পহেলা নবেম্বর ব্লাক আউট এর ঘটনার দিন কিন্তু আরপিসিএল ৩০ মেগাওয়াট এবং শাহজীবাজার ২০ মেগাওয়াট ছাড়া আর কোন বিদ্যুত কেন্দ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হতে পারেনি। এজন্য সকল বিদ্যুত কেন্দ্রে ব্লাক স্ট্রাট ব্যবস্থার সংযোজন করতে বলা হলেও পুরাতন কেন্দ্রে তা করা সম্ভব নয়। এজন্য জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হলে বিতরণ ব্যবস্থা বিঘিœত হয়। জানতে চাইলে পাওয়ারসেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসানাইন জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার ধীরে ধীরে বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে। উন্নত দেশে সব বৈদ্যুতিক তার মাটির নিচে দিয়ে প্রবাহিত। কিন্তু আমাদের এখানে মাটির উপরে রয়েছে। ঝড় বৃষ্টিতে গাছের ডালপালা পড়ে আবার বিল্ডিংয়ের পানি তারের ওপর পড়ে দুই তার একত্রিত হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। আবার অনেক সময় মাটির নিচে দিয়ে প্রবাহিত কেবেলেও ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে কেটে যায়। এতেও বিপত্তি হয়। যেহেতু ক্রমাগতভাবে উন্নয়ন কর্মকা- চলছে তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও সহজ নয়।
×