ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেই ৪ ভাগ মানুষ চলে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৭ এপ্রিল ২০১৫

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেই ৪ ভাগ মানুষ চলে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে

নিখিল মানখিন ॥ দেশের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় অধিকাংশ মানুষের নাগারের বাইরে। আর্থিক সঙ্কটে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর অকালে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগকেন্দ্রিক। জটিল জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের মাত্রাও অনেকগুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ জটিল ধরনের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থবিরতার লক্ষণ দৃশ্যমান। সুস্বাস্থ্য এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সফলতা পেয়েছে সরকার। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নিরাপদ পুষ্টিকর খাবার- সুস্থ জীবনের অঙ্গীকার’। হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফিনান্সিং রিসার্চ দলের প্রধান জাহাঙ্গীর এ এম খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে চার শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা রবার্ট ইয়েটস বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারী বরাদ্দ বেশি হবে, না কম হবে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি বলেন, যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে অগ্রসর হয়েছে বা কিছু সাফল্য অর্জন করেছে তা মূলত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ফলে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোঃ সিফায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, থানা ও জেলা পর্যায়ে কম খরচে জটিল রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে দরিদ্র মানুষ উপকৃত হতো। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার জন্য ব্যয় করতে হতো না। মানসম্মত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারীদের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। মানসম্মত সেবাদানের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা না থাকলে ভাল স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব না। স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়নে বর্তমান সরকার বহুমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছে। জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। কারণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, আরও বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জনবল বাড়াতে হবে। আর বর্তমান সরকারের ইতোমধ্যে গৃহীত ও চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য সেক্টরের বাজেট বৃদ্ধি করা দরকার। আর তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করবেন, তাদের জন্য উৎসাহ ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত মনে করেন বিএমএ মহাসচিব। স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিকনির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, সরকারী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে বেশ আলোচিত হয়ে আসছে। বর্তমান সরকারও এ সমালোচনা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারী চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার ফের বেড়েছে। তাদের কেউ কেউ কর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর দিয়েই চলে যান। অনেকে আসেন দিনের শেষ বেলায়। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসকদের দেখা পায় না রোগীরা। তবে নিজেদের আবাসিক কক্ষে গড়ে তোলা অবৈধ চেম্বারে অফিস সময়ে চড়া ফি নিয়ে রোগী দেখতে ভুলেন না চিকিৎসকরা। কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত পরিদর্শন টিমের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। থানা পর্যায়ে টিমের সদস্যরা যান না। শুধু তাই নয়, থানা পর্যায়ে সকল রোগীকে বিনা টাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অনুকম্প ছাড়া ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে, স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য বিষয়ক সহস্রাব্দ অর্জনেও এদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক। এমন মজবুত অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা। বর্তমানে প্রতি মাসে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নেন। দেশে অনুর্ধ ১২ মাস বয়সের শিশুদের সকল টিকা প্রাপ্তির হার ৮১ ভাগ। বিদ্যমান অবকাঠামোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান সারাবিশ্বের অনুকরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি (এইচপিএন) খাতের বিদ্যমান বাধাসমূহ দূর করে এই কর্মসূচীকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জুলাই ২০১১ থেকে জুন ২০১৬ মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচী (এইচপিএনএসডিপি) বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত এইচপিএসপি (১৯৯৮-২০০৩) এবং এইচপিএনএসডিপি (২০০৩-১১) এর লব্ধ অভিজ্ঞতা, সরকারের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, রূপকল্প-২০২১ এবং স্বাস্থ্যনীতির আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তৃতীয় সেক্টর কর্মসূচী এইচপিএনএসডিপি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উপ-খাতসমূহের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো জনগণের বিশেষ করে মহিলা, শিশু এবং সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেবা প্রাপ্তির চাহিদা বৃদ্ধি, কার্যকর সেবা প্রাপ্তি সহজলভ্য এবং স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেবাসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, রোগের প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুর হার হ্রাস এবং পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা। স্বাস্থ্য বিষয়ক সহস্রাব্দ অর্জনে বাংলাদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও উন্নয়ন অতুলনীয় এবং বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার এমন অবকাঠামো বিশ্বের কোথাও নেই। বিশ্বের অনেক দেশের চিকিৎসাসেবা অত্যাধুনিক হতে পারে। কিন্তু ওই সব দেশে স্বাস্থ্যসেবার ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী নয়। বাংলাদেশ চিকিৎসক সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএমএর বর্তমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ডাঃ মুস্তাক হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার মান আগের তুলনায় বেড়েছেÑ এতে কোন সন্দেহ নেই। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন অবকাঠামো। জনবল বেড়ছে। কিন্তু উন্নয়ন কর্মকা- মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে গেছে। মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় সরকারী হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার চিত্র বেরিয়ে আসে। হয়রানি ও দুর্ভোগের অভিযোগ তুলেন রোগী ও তাঁদের অভিভাবকরা। সরকারের একার পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হতে হবে আন্তরিক। বিদ্যমান জনবল ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হলে স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন ডাঃ মুস্তাক হোসেন।
×