ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ কোটি টাকার গাছ ৬০ লাখে বিক্রি

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৮ এপ্রিল ২০১৫

পাঁচ কোটি টাকার গাছ ৬০ লাখে বিক্রি

নিজন্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ৭ এপ্রিল ॥ সামাজিক বনবিভাগ পাবনার আওতাধীন সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলায় সওজ বিভাগের রাস্তার দু’পাশের প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির ১ হাজার ৪শ’ ৫২টি গাছ মাত্র ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের রাঘববোয়াল, বন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ১৯৯২-৯৩ সালে শাহাজাদপুরের দ্বারিয়াপুর বাজার থেকে কৈজুড়ি বাজার পর্যন্ত এলজিইডি’র প্রায় ১১ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে আকাশমনি, জারুল, ইউকেলিপটাস, রেন্ডি কড়ই ও বাবলা গাছের চারা রোপণ করা হয়। বর্তমানে প্রতিটি গাছের দাম ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। এলজিইডি ২০১১ সালে রাস্তাটি সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ রাস্তাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। ২০১৩ সালে সিরাজগঞ্জের সাঁকো প্রতিবন্ধী সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গাছের মালিকানা দাবি করে। সাঁকো প্রতিবন্ধী সামাজিক বনায়ন প্রকল্পটি ২০০০ সালের পরে সরকারের অনুমোদন লাভ করেছে। অভিযোগে জানা যায়, সাঁকো প্রতিবন্ধী সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক এম এ হাসিম ২০১৩ সালে বিভিন্ন প্রজাতির ১ হাজার ৪’শ ৫২টি গাছ বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করেন। চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। সর্বোচ্চ দরপত্রে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা। পরে বিক্রির প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাসেল সাবরীনের কাছে উপস্থাপন করা হয়। সাঁকো প্রতিবন্ধী মালিকানার উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তিনি প্রস্তাবনাটি বাতিল করে দেন। অবশ্য এর পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে নাটোরের লালপুরে বদলি করা হয়। নির্বাহী অফিসার রাসেল সাবরীনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। শাহজাদপুর উপজেলার রূপবাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেনের নেতৃত্বে চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের দ্বারিয়াপুর বাজার-কৈজুড়ি রাস্তার গাছ কাটা শুরু করে। তখন বিষয়টি সর্বসাধারণের মাঝে জানাজানি হয়। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক, সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, পাবনা সামাজিক বনায়ন বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক এবং শাহাজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও গাছ বিক্রি এবং কাটার ব্যাপারে কিছু জানেন না। ইতোমধ্যে ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ দিয়ে প্রশাসন, রাজনৈতিক মাস্তান এবং সংবাদ কর্মীদের ম্যানেজ করে গাছকাটা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথম দরপত্রের চেয়ে যদি দ্বিতীয় দরপত্রের দর কম হয় তাহলে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একাধিক কমিটি গঠন করে সরেজমিন তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সে নিয়ম বা বিধান মানা হয়নি। প্রথম দরপত্রে গাছের দাম উঠেছিল এক কোটি ৩২ লাখ টাকা। অথচ পরবর্তীতে ওই গাছ ৭২ লাখ টাকা কম দামে অর্থাৎ মাত্র ৬০ লাখ টাকায় বিক্রির ঘটনা রহস্যজনক। বৃক্ষরোপণ ক্ষেত্রে নিয়ম রয়েছে, বন অধিদফতর শতকরা ১০ ভাগ, ভূমির মালিক শতকরা ২০ ভাগ, উপকারভোগীরা শতকরা ৫৫ ভাগ, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ শতকরা পাঁচ ভাগ এবং বৃক্ষরোপণ তহবিল শতকরা ১০ ভাগ হারে শেয়ার পাবে বলে তিনি জানিয়েছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সড়কটি শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহনগর, পোড়জোনা ও কৈজুড়ি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। গোপালপুর, উল্টাডাব, রানীকোলা, ছোট মহারাজপুর নামক স্থানে গাছ কেটে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ট্রাক, নসিমনে করে কাটাগাছ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। অনেক স্থানে কাটাগাছের গোড়া ও শিকড় তুলে ফেলা হয়েছে। এলাকার আজগর ব্যাপারী, রস্তম আলী, ফরিদ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, গত প্রায় ২০ দিন ধরে গাছ কেটে ট্রাকে ও নছিমনে করে নিয়ে যাচ্ছে। এক একটি গাছ ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা দামে বিক্রি হবে। বড় গাছের সংখ্যাই বেশি। শাহজাদপুর উপজেলার রূপবাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন জানান, তিনি সাঁকো প্রতিবন্ধী সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের কাছ থেকে টেন্ডারে সকল নিয়ম মেনে ৭৮ লাখ টাকায় গাছ কিনেছেন। প্রায় ২০ দিন হলো গাছ কাটা হচ্ছে। বনভিাগ, এলজিইডি, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সকলেই বিষয়টি জানেন। এ জন্যই তাঁরা বাধা দিচ্ছেন না। টেন্ডারে গাছ কেনার বৈধ কোন কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি। সাঁকো প্রতিবন্ধী সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক এমএ হাসিমের সাঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকল্পটি ২০০০ সালের পরে অনুমোদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, শাহজাদপুর উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির রেজুলেশনের ভিত্তিতে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর পত্রিকায় টেন্ডার আহ্বানের মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকায় গাছ বিক্রি করা হয়েছে। বন বিভাগ এবং এলজিইডি’র কর্মকর্তারা এ বিষয়টি জানেন। এই টাকা প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে বলে তিনি জানান। তবে কোন পত্রিকায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল তা তিনি বলতে পারেননি। শাহাজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি নিজে এমনকি এলজিইডি’র শাহজাদপুর উপজেলা প্রকৌশলী এ বিষয়ে কিছু জানেন না। উপজেলা প্রকৌশলী বাদল চন্দ্র জানান, এলজিইডি’র দারিয়াপুর-কৈজুড়ি রাস্তাটি ২০১১ সালে সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাস্তাটির স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তির দায়দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ বিভাগের। তাদের করার কিছু নেই। সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আযাদ এলজিইডি’র কাছ থেকে রাস্তাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগে হস্তান্তরের কথা স্বীকার করে বলেন, একাধিক বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও রাস্তার দু’পাশের গাছ বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। পাবনা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক মোঃ সাইদুল ইসলাম শাহজাদপুরের দারিয়াপুর-কৈজুড়ি সড়কের গাছের মালিকানা বন বিভাগের নয় বলে জানিয়েছেন। শাহজাদপুর বন বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন ফোনে গাছ বন বিভাগের দাবি করে বলেন, তিনি নিজে থেকে গাছ লাগিয়েছেন। এর তথ্য প্রমাণ পাবনা বিভাগীয় অফিসে অবশ্যই সংরক্ষিত থাকার কথা বলে তিনি জানান। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বেল্লাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গাছ বিক্রি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। এমন কোন আদেশও তিনি দেননি বলে জানিয়েছেন। এদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাছ বিক্রির দায়দায়িত্ব প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগই স্বীকার করছে না। ফলে এ নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে এর দায়দায়িত্ব কার?
×