ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে চাপের মুখে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৯ এপ্রিল ২০১৫

অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে চাপের মুখে  বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ এখনও নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী অবরোধ প্রত্যাহার না করায় ঘরে-বাইরে চাপের মুখে বিএনপি। আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলীয় প্রার্থীরাও এজন্য সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে দলের হাইকমান্ড অবরোধ কর্মসূচী তুলে নেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। তাই যে কোন দিন চলমান অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহারের ঘোষণা আসবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা যায়, আন্দোলনে কিছু অর্জন ছাড়াই ৯২ দিন পর ৫ এপ্রিল গুলশান কার্যালয় থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বাসায় ফিরে গেলেও হরতালের মতো অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার না করায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করে। ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা ইতোমধ্যেই কোন কোন বিএনপি নেতার কাছে অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত রাখার কারণ জানতে চেয়েছেন। বুধবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকালে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনও অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার করে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার করে নিতে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকেও এ কর্মসূচী তুলে নেয়ার অনুরোধ এসেছে। আন্দোলনে সফলতা না আসলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হবেন না আগে এমন অবস্থানেই অনড় থাকলেও ৫ এপ্রিল আদালতে গিয়ে জামিন পেয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরে যান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু তারপরও যে কর্মসূচীকে ঘিরে তিনি ৯২ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করলেন সেই অবরোধ কর্মসূচী এখনও তিনি প্রত্যাহার করেননি। তবে খালেদা জিয়া বাসায় ফিরে যাওয়ার পর থেকেই নিষ্ফল এই অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে চারদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে বিএনপি আসন্ন ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলেও অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত থাকায় দলের নেতাকর্মীরা নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। আর একদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও অপরদিকে নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী অব্যাহত রাখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর নজরদারিতে রাখছে বিএনপি দলীয় প্রার্থী-সমর্থকদের। এ পরিস্থিতির কারণে নির্ভয়ে প্রচার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না তারা। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করে যে কোন দিন হরতালের মতো অবরোধ কর্মসূচীও প্রত্যাহারের ঘোষণা আসতে পারে। তবে তার আগে কর্মসূচী প্রত্যাহার করার পর নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচার কাজে বাধা দেয়া হবে না এমন আশ্বাস পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ৯৩ দিন ধরে চলা অবরোধ কর্মসূচীতে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে নাশকতা চালিয়ে প্রায় দেড়শ’ মানুষকে হত্যা করে। এর মধ্যে শুধুু পেট্রোলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে প্রায় ৭০ জন। পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখনও সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরও শতাধিক মানুষ। এ কর্মসূচী চলাকালে সহস্রাধিক যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। ভাংচুর করেছে আরও কয়েক হাজার যানবাহন। এছাড়া সারাদেশের ক’টি ভূমি অফিস এমনকি স্কুল-কলেজ ও ডিসি অফিসে পর্যন্ত বোমা বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। সব মিলিয়ে ৯৩ দিনের আন্দোলনে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন তথ্য প্রকাশ করেছে। জানা যায়, অবরোধ কর্মসূচী বহাল থাকায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাই অস্বস্তিতে রয়েছেন। এছাড়া এ কর্মসূচীর কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিএনপি নেতাকর্মীদের চোখে চোখে রাখছে। আর এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মীরা জরুরী প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করছেন না। এমনকি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষেও প্রচার চালাচ্ছেন না। এ কারণেই আপাতত বিএনপির কোন কর্মকা- চোখে পড়ছে না। তবে আজ-কালের মধ্যেই বিএনপি নেতাকর্মীরা ৩ সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে এ কর্মসূচী সফল করতে ২ দিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। এখানে থেকেই তিনি ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এর আগে থেকেই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অবস্থান করতে থাকেন। ৩ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকালে খালেদা জিয়ার জানতে পারেন নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত রুহুল কবির রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন খালেদা জিয়া রিজভীকে দেখতে গুলশান কার্যালয় যেতে চান। কিন্তু খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির কর্মসূচীকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে যাবেন এমন আভাস পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং তাকে সেখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে বাধা দেয়। সেই সঙ্গে রাতেই রিজভীকে এ্যাপোলে হাসপাতালে ভর্তি করে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরদিন ৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুই পাশে ব্যারিকেড দিয়ে র্যাব-পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য সেখানে অবস্থান করে। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার বাসা সংলগ্ন ৮৬ নম্বর সড়কের দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ১২টি ইট, বালি ও মাটিভর্তি ট্রাক, ২টি প্রিজন ভ্যান ও ১টি সাজোয়া যান ও ১টি জলকামান কার্যালয়টি অবরুদ্ধ করা হয়। ৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। গাড়িতে চড়ে বসলেও পুলিশ গেট খুলে না দেয়ায় গুলশান কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেটে লাথি মেরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে ছুড়ে মারে। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। বুধবার টানা অবরোধ কর্মসূচীর ৯৩তম দিন অতিবাহিত হয়েছে। অবশ্য অবরোধের মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ১৫ জানুয়ারি সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপি। এর পর ২ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই সরাদেশে হরতালও পালন করতে থাকে বিএনপি জোট। তবে স্বাধীনতা দিবসের আগে পরে কয়েকদিন হরতাল পালন না করলেও ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত আবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাড়া সারাদেশে হরতাল পালন করছে তারা। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এ ক’দিন হরতাল দেয়নি বিএনপি জোট। তবে ৯২ দিন পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় ছেড়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার দিন অর্থাৎ ৫ এপ্রিল থেকে আর হরতাল দেয়া হয়নি। তবে কেউ পালন না করলেও অকারণে অবরোধ কর্মসূচী বহাল রেখে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এদিকে বিএনপি জোট অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত থাকলেও এ কর্মসূচীর ব্যাপারে জানে না খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। বুধবার দুপুরে সেগুনবাগিচা এলাকায় রিক্সাচালক মুমিন মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামায়াতের হরতালের কথা জানি কিন্তু বিএনপির অবরোধ আছে কিনা জানি না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া তো অফিস থেকে বাসায় চলে গেলেন এখন আবার অবরোধ কিসের? পল্টন এলাকায় ফুটপাথের ফল বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, অবরোধ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই রাস্তাঘাটে এখন আর পেট্রোলবোমার ভয় নেই। এর আগে একটি চলন্ত বাসে কথা হয় গাজীপুরের স্কুল শিক্ষক হাফিজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। বিএনপি জোটের অবরোধ কর্মসূচীর কথা জানেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন অবরোধ পালন করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তো তার গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে গেলেন। তারপর থেকে আর কোন আন্দোলন কর্মসূচী নেই আমরা এমনটিই জানি। তাহলে এখনও অবরোধ থাকবে কি করে। অবরোধ কর্মসূচী এখনও অব্যাহত আছে তাকে জানানোর পর কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, এখনও কিসের অবরোধ, কার জন্য এ অবরোধ। জান-মালের এত ক্ষতি হওয়ার পরও কি তারা থামবে না? ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৮নং ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় এক কাউন্সিলর প্রার্থী জানান, অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত থাকায় নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন আপনারা নির্বাচনে এলেন তাহলে এখনও অবরোধ কর্মসূচী কেন? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিব্রত হতে হচ্ছে। তাই আমরাও আশা করছি শিঘ্রই অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার হোক। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ আর অবরোধ চায় না এটা আমরাও বুঝতে পারছি। তাই অবরোধ কর্মসূচী অবশ্যই তুলে নেয়া হবে। কৌশলগত কারণে কিছুটা সময় নেয়া হচ্ছে।
×