ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ মহেশখালীর এক মামলায় ৪০ জন আসামি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৯ এপ্রিল ২০১৫

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ মহেশখালীর এক মামলায় ৪০ জন আসামি হচ্ছে

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এই প্রথম কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে একটি মামলাতেই ৪০ জনের বেশি আসামি করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোরী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এই মামলায় মহেশখালীর তিন রাজাকার সালামতউল্লাহ খান, মৌলভী জাকারিয়া সিকদার ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএ-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর সালামতউল্লাহ খান ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএকে গ্রেফতার করে মহেশখালী পুলিশ। এখন তদন্তে এই মামলার আসামির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। যার সংখ্যা ৪০-এরও বেশি হতে পারে। তদন্ত শেষে সত্বরই চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, মহেশখালীর গোরকঘাটা বাজার, গোরকঘাটা রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির, গোরকঘাটা দক্ষিণ হিন্দুপাড়া মাতব্বর বাড়ি, গোরকঘাটা সরকারপাড়া, গোরকঘাটা পুটিবিলা পালপাড়া, ঠাকুরতলা, ঠাকুরতলা রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির, গোরকঘাটা পশ্চিমপাড়া, আদিনাথ মাইগ্যাঘোনা পাহাড়ী এলাকা, পুটিবিলা কায়স্থপাড়া, মহেশখালী নাপিতপাড়া, বড়মহেশখালী হিন্দুপাড়া, বড়মহেশখালী গোরস্থান হিন্দুপাড়া, বড়মহেশখালী দেবঙ্গাপাড়া, বড়মহেশখালী মুন্সীরডেইল, আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আসামিগণ গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সকল ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কক্সবাজারের মহেশখালীতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। গণধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনশত বছরের পুরনো রাখাইন মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা সেখানে গিয়ে তদন্ত করেছি। অনেক সাক্ষী পাওয়া গেছে। মহেশখালীতে হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে মুসলমান করা হয়েছে। অনেক হিন্দুকে খতনা করা হলে তারা ইনফেকশনের কারণে মারা গেছে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হবার পর পুনরায় তারা হিন্দুধর্মে ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা সেখানে তদন্ত করে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছি। আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। আসামির সংখ্যা প্রায় ৪০ জনেরও বেশি হতে পারে। মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। আরও একবার সেখানে যেতে হবে। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেছেন, মহেশখালীতে যে গণহত্যা হয়েছিল তাতে সাক্ষীরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে তেমন তথ্য নেই। সেখানে কোন স্মৃতিসৌধও নেই। শুধু একটি মন্দিরের দেয়ালে কয়েকজন শহীদের নামফলক রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তদন্ত সংস্থা ও আমরা গিয়ে নতুন নতুন তথ্য পেয়েছি। মামলার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৪ এপ্রিল থেকে ৬ এপ্রিল তদন্তসংস্থা ও প্রসিকিউশনের একটি দল সেখানে গিয়ে তদন্ত করেন। দলে ছিলেন তদন্ত সংস্থার প্রধান এম এ হান্নান খান, সমন্বয়ক সানাউল হক, তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম, তদন্ত কর্মকর্তা ওবায়দুল হক, প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। প্রতিনিধির সবাই চলে আসলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম রয়ে গেছেন। তিনি শুক্রবার ঢাকায় ফিরবেন বলে জানা গেছে। এই মামলায় ১৯ এপ্রিল অগ্রবর্তী প্রতিবেদন জামা দেয়ার দিন রয়েছে। ১ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর তিন রাজাকার সালামতউল্লাহ খান, মৌলভী জাকারিয়া সিকদার ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএ-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসামি সালামতউল্লাহ খান ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএকে গ্রেফতার করেছে মহেশখালী পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ, হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোরী অপরাধ করেছেন। মহেশখালী থানায় বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ী এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নিয়ে গিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীতে আশ্রয় নেয়া অগণিত লোককে হত্যা করে। এ ছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করে তারা তা মসজিদে রূপান্তর করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত লোকজনদের সেখানে নামাজ পড়তে বাধ্য করে। যে সমস্ত হিন্দুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য খতনা করান হয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ এলাকার অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায়। অনেক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিবাহ করতে বাধ্য করে। অভিযুক্ত প্রতিপক্ষ মৌলভী জাকারিয়া সিকদার নিজেই পুলিন বিহারী পালের কন্যা শিখা রানীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করে। এমনকি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোরপূর্বক বিবাহ করতে বাধ্য করে এই আসামি। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আসামিগণ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমর্থক, সংগঠকসহ সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগণকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য বর্তমান কক্সবাজার জেলাধীন মহেশখালী থানা এলাকায় সকল প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। একাত্তরের ৩০ এপ্রিল মহেশখালী থানা শান্তি কমিটি গঠন করে। ওই দিন দুষ্কর্মের সহচরদের নিয়ে মহেশখালী থানার কালারমারছড়া বাজারে বাদ মাগরিব ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কথিত শান্তির লক্ষ্যে একটি শান্তি মিটিংয়ের আয়োজন করে। শান্তি মিটিংয়ে স্থানীয় কালারমারছড়ার ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোঃ শরীফ আহমদকে চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সভাপতি করে অভিযুক্ত তিন জনের যোগসাজশে কথিত সভা শুরু করে। তাদের গোপন ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তৎকালীন মহেশখালী থানার ওসি শামসুল হকের নেতৃত্বে এক দল সশস্ত্র পুলিশ সদস্য ওইদিন রাত আনুমানিক ৮টার দিকে কালারমারছড়া বাজারে অনুষ্ঠিত কথিত শান্তি মিটিংয়ের জায়গায় উপস্থিত হয়। ওই সময় কথিত শান্তির মিটিংয়ে উপস্থিত শান্তি কমিটির লোকজন পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ‘পাঞ্জাবী এসেছে, পাঞ্জাবী এসেছে’ বলে হৈ-হুল্লা শুরু করে। তাদের ওই হৈ-হল্লায় আতঙ্কিত হয়ে সভায় উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক লোকজনেরা প্রাণভয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে এলোপাতাড়িভাবে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ওই মুহূর্তে অভিযুক্ত প্রতিপক্ষ সালামতউল্লাহ খান ও মৌলভী জাকারিয়া সিকদারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মহেশখালী থানার তৎকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি, শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিযুক্ত মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএ তার হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে শরীফ আহমদ চেয়ারম্যানকে গুলি করে। একই সঙ্গে মহেশখালী থানার তৎকালীন ওসি শামসুল হক নিজের পিস্তল দিয়ে একই কায়দায় শরীফ আহমদ চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে গুলি করে। একাত্তরের ৩ মে সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে কালারমারছড়া ইউনিয়ন অফিসের সামনে থেকে খুন করায় বদমতলবে তাদের আটক করা হয়। ৬ মে বিকেল আনুমানিক পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে আটককৃতদের হাত, চোখ বেঁধে কক্সবাজার আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে আটককৃত শফিকুর রহমান ও ইউনুচকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একাত্তরের ৫ মে দুপুরবেলা দখলদার পাকিস্তানী আর্মি কক্সবাজার সদরে আগমন করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ খবর পেয়ে ওইদিনই অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ তাদের ঘনিষ্ঠ সহচর দুষ্কর্মের সহযোগী শান্তি কমিটির ও নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী লোকজনদের নিয়ে মহেশখালী থানা এলাকা থেকে নৌকাযোগে কক্সবাজার সদরে এসে পাকিস্তানী পতাকা হাতে মিছিলসহকারে দখলদার পাকিস্তানী আর্মির ক্যাম্পের গিয়ে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মহেশখালী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে এর পরের দিন অর্থাৎ ৬ মে সকাল ১০টার দিকে দখলদার পাকিস্তানী আর্মির শতাধিক সদস্য ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত দ্বীপাঞ্চল মহেশখালী থানাধীন গোরকঘাটা জেটিঘাটে আসে। তারা একযোগে গোরকঘাটা বাজার এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীদের দোকানপাটে ব্যাপক লুটপাট চালায়, অনেককে হত্যা করে। উক্তরূপে বাজার এলাকায় লুটপাট ও গণহত্যা সংঘটিত করার পর অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুষ্কর্মের সহচরদের বিভিন্ন দলে ও গ্রুপে ভাগ করে এবং নিজেরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়ে মহেশখালী থানাধীন বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ী এলাকায় আর্মিদের নিয়ে গিয়ে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় আশ্রিত অগণিত লোককে হত্যা করে গণহত্যা চালায়। তদন্ত সংস্থা তদন্তে দেখা যায় , আগের তিন আসামির সঙ্গে অন্যান্য আসামিগণও জড়িত রয়েছে। তাদের পরিকল্পনায় ও উপস্থিতিতে তারা তাদের দুষ্কর্মের সহচর দলীয় অনুসারী ও শান্তি কমিটির লোকজন এবং দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৬ মে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়কালে একটানা
×