ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুক্তিযুদ্ধের বিপন্ন চেতনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১০ এপ্রিল ২০১৫

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুক্তিযুদ্ধের বিপন্ন চেতনা

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে, সরকারী হিসাবে ২ লাখ, বেসরকারী হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে, কয়েক কোটি মানুষের চরম দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে বাঙালী মুসলমানদের অধিকাংশ মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। এলিটরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন মনোজগতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষের কারণে। অন্যদিকে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ ভাগ্যের পরিবর্তন হবে ভেবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তাদের মনোজগতে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিল- পাকিস্তান হলে হিন্দু জমিদার মহাজনদের শোষণ-পীড়ন থাকবে না, ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের জন্য দুধ-মধুর নহর বইবে। পাকিস্তান সম্পর্কে এদেশের বাঙালী মুসলমানদের মোহভঙ্গ ঘটেছে ১৯৪৮-১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময়ে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের কাল থেকে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনা মুসলিম বাঙালীদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ২০ বছরের পাকিস্তানী শাসন-পীড়ন-বঞ্চনা-অসাম্য ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা নাকচ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বোধের জমিন তৈরি করে। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তাদের সকল কর্মকাণ্ডে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে সজাগ ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আইনী বৈধতা দিয়েছে ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ঘোষিত এবং মুজিবনগর থেকে জারিকৃত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে কোন্্ পরিস্থিতিতে কী কারণে জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য কী হবে এবং সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যে সব দেশ ও জাতি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রণয়ন করে সেই ঘোষণার ভিত্তিতে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেখানেও স্বাধীন রাষ্ট্রের চরিত্র ও সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে সেভাবে বলা হয়নি যেভাবে বলা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ’৭১-এ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রবিরোধী দলিল। বাংলাদেশে যাদের মনোজগত এখনও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা সুযোগ পেলেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে। তারা বিলক্ষণ জানে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র নাকচ করে দিলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ রূপান্তরিত হবে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো গৃহযুদ্ধে। তখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ রূপান্তরিত হবে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে, যার পরিণতি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব অপরাধের বিচার নয়, ‘ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন’Ñ যেমনটি করে নেলসন ম্যান্ডেলা যৌথভাবে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ক্লার্কের সঙ্গে। বাংলাদেশে বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আছে, যাদের বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগ তথা ’৭০-এর নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেছেন; যারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা ও অনুমোদনসহ ১৯৭৩-এর নির্বাচন পর্যন্ত যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এসব ক্ষমতা তাদের দিয়েছে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, যা প্রণয়ন ও ঘোষণার ষোলোআনা এখতিয়ার কেবল তাদেরই ছিল। পরবর্তীকালে সুপ্রীমকোর্টের এক রায়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’কে বাংলাদেশের সংবিধানের ‘জেনেসিস’ বা সৃষ্টিতত্ত্ব বলা হয়েছে। ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের যে সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের সেরা ছয়টি সংবিধানের অন্যতম সেই সংবিধান অগ্রাহ্য ও নাকচ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী তাঁর সহযোগীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক-মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের আদি সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পাকিস্তানপন্থীরা এটি পছন্দ করেনি বলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ মুছে ফেলার পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনীতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটিও বাতিল করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণ ও ইসলামীকরণের জন্য সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন বপন করেছিলেন সেটি এখন পত্র-পুষ্প-পল্লবে বিকশিত হয়ে বিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার জমিনে এই বিষবৃক্ষের শিকড় বহু দূর অবধি বিস্তৃত হয়েছে। যে প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি, যারা বেড়ে উঠেছে পঁচাত্তরোত্তর অন্ধকার সময়ে তাদের মনোজগতে পাকিস্তান ও মওদুদিবাদী ইসলাম কিভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মৌলবাদী ঘাতকরা রাজধানীতে ছুরি-চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিত রায়কে। ঘাতকদের বাধা দিতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন অভিজিতের সহধর্মিণী বন্যা আহমেদ। ঢাকার রাজপথে অভিজিত আর বন্যার রক্তের দাগ মুছে যাওয়ার আগেই মৌলবাদী ঘাতকরা গত ৩০ মার্চ প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে কুপিয়ে হত্যা করেছে মুক্তচিন্তার আরেক লেখক ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। অভিজিতের খুনীরা এখন পর্যন্ত ধরা না পড়লেও বাবুর দু’জন ঘাতককে পথচারী সাধারণ মানুষরা ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছেন। অন্য ঘাতকরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ধৃত জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ধৃত ঘাতকদের একজন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আহমদ শফীর হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র, অপরজন মিরপুর দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে- দু’জনের কেউ ওয়াশিকুর রহমানকে চিনত না, তার কোন লেখাও পড়েনি, ব্লগ কী বস্তু তাও তারা জানে না। তাদের হুজুর (নেতা) বলেছে ওয়াশিকুর রহমান নাস্তিক, ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে, তাকে হত্যা করতে হবে। তাদের গ্রুপের একজন ওয়াশিকুর রহমানকে চিনিয়ে দিয়েছে, একজন ছুরি-চাপাতি এনে দিয়েছে, ওরা নেতার নির্দেশ অনুযায়ী বাবুকে হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছে এবং এর জন্য তারা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। বলা হয়েছে নাস্তিক মারলে তারা বেহেশতে যাবে। তরুণদের মনোজগতে এই উন্মাদনা তৈরি করছে জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন মওদুদীবাদ। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার চেতনার প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে এই ‘মওদুদীবাদ’। ১৯৯৯-এর ১৮ জানুয়ারি হরকতুল জিহাদের জঙ্গীরা বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর তারা একের পর এক মুক্তচিন্তার লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। কখনও মাঠ পর্যায়ের ঘাতকরা গ্রেফতার হয়েছে কিন্তু আসল হুজুররা সব সময় পর্দার অন্তরালে থেকে গেছে। শামসুর রাহমান হত্যা প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, সাংবাদিক মানিক সাহা, অধ্যাপক ইউনুস, অধ্যাপক তাহের, অধ্যাপক শফিকুর, ব্লগার রাজীব প্রমুখের প্রকৃত ঘাতকরা ধরা পড়েনি, মাঠপর্যায়ের যারা ধরা পড়েছিল তাদের প্রায় সবাই পরে জামিনে বেরিয়ে গেছে। গত বছরের শেষে হাইকোর্ট থেকে হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানেরও জামিন হয়ে গিয়েছিল, সুপ্রীমকোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে যা বাতিল হয়েছে। তখন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন- হান্নানের মতো আত্মস্বীকৃত জঙ্গী ঘাতককে হাইকোর্টের যে বিচারক জামিন দিয়েছেন তাঁর বিচার হওয়া উচিত। মুক্তচিন্তার লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কারণ হিসেবে মৌলবাদীরা বলছে তারা ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’- অতএব তাদের হত্যা করা হচ্ছে ইমানি দায়িত্ব। ‘মওদুদীবাদী’ ওহাবিরা এভাবে দেশে দেশে ইসলামের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসকে বৈধতা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক জিহাদী সংগঠন ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’ যে কারণে যেভাবে ইসলামের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করছে কিংবা সভ্যতার স্মারক ধ্বংস করছে- বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় মওদুদীবাদী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা একই উদ্দেশ্যে একইভাবে হত্যা ও সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে। এদের রাষ্ট্রিক ও আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক নির্মূল করতে না পারলে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, মানবিকতার ঐতিহ্য- সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশ্বের মানচিত্রে সভ্য দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে চাইলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল ধারায়। ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার শ্রেয়োচেতনাই পারে একটি দেশ ও জাতিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে। ৮ এপ্রিল ২০১৫
×