ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উখিয়ার গহীন অরণ্যে জঙ্গী স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১০ এপ্রিল ২০১৫

উখিয়ার গহীন অরণ্যে জঙ্গী স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ

স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার/ নিজস্ব সংবাদদাতা, উখিয়া ॥ কক্সবাজারের উখিয়ায় বনবিভাগের ভূমি অবৈধ দখলে নিয়ে জঙ্গী অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত অর্ধশত সেমিপাকা স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়েছে জেলা প্রশাসন। এ ঘটনায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছে সাংবাদিকসহ ২২ জন। উল্লেখ্য, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির সন্নিহিত পাহাড়ি বনবিভাগের মালিকানার ভূমিতে এ সব স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এ সব স্থাপনা কারা কিভাবে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে তুলতে সক্ষম হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, এলাকার রাজনীতিবিদদের সহযোগিতা ছাড়া এ সব অবৈধ স্থাপনা গড়া সম্ভব নয়। আরও অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতারা এর নেপথ্যে যোগানদাতা। স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়, কক্সবাজারের উখিয়া রেঞ্জ সদর বনবিটের আওতাধীন মধুরছড়া এলাকায় প্রায় ১০ একর বনভূমি দখল করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রহস্যময় ৫০টি সেমিপাকা স্থাপনা। এ সব স্থাপনা আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত বলে অভিযোগ ওঠার পর প্রশাসন এ নিয়ে তদন্তে নামে। তদন্তে পাওয়া যায় বনবিভাগের বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় করে এ সব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের টাস্কফোর্স বিপুলসংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলের অদূরে পৌঁছায়। এ বিষয়ে আগে থেকে বিজিবিকে অবহিত করে রাখা হয় এবং বিজিবি সদস্যরা স্ট্যান্ডবাই অবস্থানে থাকেন। সকাল ৮টার দিকে টাস্কফোর্সের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই খবর পেয়ে যায় এবং অবৈধ এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা ও স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল নারী পুরুষের বিরাট একটি দল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ কাজে রোহিঙ্গাদের প্রতি দরদ দেখানো সরকার দলীয় কতিপয় নেতা উস্কানিতে লিপ্ত হয়। এদের গোপন সহযোগিতায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় নারী পুরুষরা জঙ্গী স্থাপনায় পৌঁছানোর পথে রাস্তা কেটে দিয়ে পাহাড়ি পাদদেশে সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থান গ্রহণ করে। সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও র‌্যাব, পুলিশ ও বনবিভাগ ও প্রশাসনের যৌথ অভিযানে অংশগ্রহণকারী দল স্থাপনা উচ্ছেদ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এমপি আবদুর রহমান বদির হস্তক্ষেপে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এমপি আবদুর রহমান বদি দুপুরে সেখানে উপস্থিত হয়ে রহস্যময় স্থাপনা উচ্ছেদে প্রশাসনকে সহযোগিতা না করে বরং একটি বৈঠকের নামে শুধু আইওয়াশ করেছেন বলে জানা গেছে। দুপুরে স্থানীয় ডাকবাংলোতে বৈঠকে এমপি বদি অবশ্য স্বীকার করে জোর গলায় বলেছেনÑ ভূমিহীনদের পক্ষে এ সব স্থাপনা নির্মাণ মোটেও সম্ভব নয়। সারিবদ্ধভাবে স্থাপনাগুলো নিশ্চয়ই কোন বিদেশী এনজিও সংস্থার অর্থায়নে গড়ে তোলা হয়েছেÑ তা স্বীকার করতে ভূমিহীন নামধারী দখলবাজদের কাছে অনুরোধ করেন এমপি বদি। ওই বৈঠকে জেলা আ’লীগ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ্যাডভোকেট আহমদ হোসেনসহ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে যাওয়া সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এমপি আবদুর রহমান বদি সিদ্ধান্ত দেন যে, আগামী ৭দিনের মধ্যে স্থাপনাগুলো তারা (দখলকারী) নিজেরা সরিয়ে নেবে। সূত্র জানিয়েছে, তুরস্কভিত্তিক একটি এনজিও সংস্থার পক্ষ হয়ে বিএনপি নেতা আবুল কাশেম স্থপনাগুলো উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রিট করতে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এজন্য এমপি বদির শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীকে রক্ষা করার মনমানসিকতায় বৈঠকের নামে আইওয়াশ করতে তিনি (এমপি) ৭দিনের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে সময় ক্ষেপণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, এ ঘটনার জের হিসেবে সকাল থেকেই প্রায় ৪ঘণ্টা ধরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উখিয়া সদর স্টেশনের দোকান-পাট বন্ধ করে দেয় দোকানিরা। সকালে ওই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কল্পে প্রশাসন ঘটনাস্থলে যাওয়ার খবর পেয়ে স্থানীয় ভূমিদস্যু ও রোহিঙ্গা নারী পুরুষদের জমায়েত করে সেখানে জয়বাংলা সেøাগান দেয়া হয়। অভিযান পরিচালনাকারী দল যাতে সেখানে যেতে না পারে, এজন্য কেটে দেয়া হয় কুতুপালং ব্রিজ সংযোগ সড়ক ও মাছকারিয়া রাস্তা। স্থানীয়দের অনেকে অভিযোগ করে বলছেন, কোন ভূমিহীনদের টাকায় নয়, জঙ্গীবাদী কর্মকা- চালাতে ভূমিহীনদের ব্যানারে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংস্থার অঢেল টাকায় এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জঙ্গীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সহযোগিতা ভূমিহীনদের নামে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে সেখানেÑ এ অভিযোগ সকলের মুখে মুখে। স্থানীয়দের নাম দিয়ে এ সব স্থাপনা গড়া হলেও পরবর্তীতে ওখানে জঙ্গী কর্মকা- পরিচালনা, রোহিঙ্গাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কাজ চালানো হবে বলে প্রশাসন নিশ্চিত হওয়ার পর এ উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতোপূর্বে কুতুপালং মোহাম্মদ আলীর ভিটা নামের এলাকায় স্থানীয়দের নামে আরও একাধিক স্থাপনা গড়ে তুলেছিল জঙ্গীরা। সেখানে বর্তমানে চলছে রোহিঙ্গা প্রশিক্ষণ। ওখানে জঙ্গীদের তালিম দেয়া হচ্ছে। নিয়োজিত রয়েছে আরএসও’র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩০ জন রোহিঙ্গা মৌলভী। বিএনপি-জামায়াতের প্রথম সারির একাধিক নেতার পরামর্শে আ’লীগ নেতার মাধ্যমে স্থপনাগুলো গড়ে তোলা হলে হয়ত নিরাপদ হতে পারে বলে আবদুর রহমান বদি এমপির শ্যালক ও উখিয়া আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সহযোগিতায় ভূমিহীনদের নামে উখিয়ার দুর্গম পাহাড়ে মাছকারিয়ায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ১০৫ জন ভূমিহীন সদস্য তাদের জমানো টাকা দিয়ে স্থাপনাগুলো গড়ে তুলেছে। মাছকারিয়া ভূমিহীন সমিতি লিমিটেডের ১০৫ জন সদস্য দীর্ঘ ৪ বছরে সঞ্চয়ী আমানতের টাকায় সেমিপাকা ৫০টি ঘর নির্মাণ করেছে। সচেতন মহল জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গীমুক্ত দেশ গড়তে বদ্ধ পরিকর। তবে কক্সবাজারের কিছু ধান্ধাবাজ নেতার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হচ্ছে চরমভাবে। কতিপয় আ’লীগ নেতা আরএসওসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর টাকার লোভে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গীবাদের আস্তানা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দিয়ে চলছে। এদিকে ভূমিহীন জাহেদা বেগম জানান, জান দেবো, তবুও ঘর ভাঙতে দেবো না। তাদের দাবিÑ তারা ভূমিহীন, তাই সরকারী জমিতে ঘর নির্মাণ করে বসবাসে তৎপর হয়েছি। টাস্কফোর্সের এ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর বেলা ৩টার দিকে পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস, আনসার সদস্যরা ফিরে যেতে বাধ্য হন। এর আগে উচ্ছৃঙ্খল রোহিঙ্গা ও স্থানীয় নারী পুরুষদের হামলায় আহত হয়েছে ২ জন সাংবাদিকসহ ২২ বনকর্মী। বর্তমানে উখিয়া সদরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের প্রায় আধাকিলোমিটার দূরে মধুরছড়া গহীন জঙ্গলের ভেতর বনবিভাগের রক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষনিধন ও মূল্যবান বনজসম্পদ দখল করে প্রায় ১০ একর জমিতে অবৈধভাবে ৫০টি একই ডিজাইনের স্থাপনা নির্মাণের নেপথ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও বিএনপি নেতা জঙ্গী মদদদাতা আবুল কাশেমের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রায় ২০ কোটি টাকার প্রকল্প অর্থায়নে নির্মিত এ সব স্থাপনা ও বনভূমি জবরদখল সম্পর্কে বিভিন্নভাবে জ্ঞাত হয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, বনবিভাগসহ সংশিষ্ট সংস্থাগুলো এ সব স্থাপনা উচ্ছেদে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বৃহস্পতিবার সরকারী একাধিক সংস্থার কয়েক শতাধিক লোকজন যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য উখিয়া সদরে এসে ওসব উচ্ছৃঙ্খল সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বাঁধার মুখে পড়েন। উখিয়া সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার ভিতরে ফলিয়াপাড়া মাছকারিয়া হয়ে মধুরছড়ার গহীন অরণ্যে যাওয়ার প্রবেশ মুখ ফলিয়াপাড়া রাস্তার মাথায় যৌথ বাহিনীকে আটকে দেয়া হয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা উখিয়ায় কর্মরত সাংবাদিক হুমায়ুন কবির জুশান, ৭১ টিভির ক্যামরাম্যান বাবু কান্তি দেসহ ২২ বনকর্মীকে নাজেহাল ও আহত করেছে। আব্দুর রহমান বদি এমপি দুপুর ১২টার দিকে এসে উচ্ছেদ অভিযানে আসা সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ স্থলে কুতুপালং হয়ে বিকল্প রাস্তায় হেঁটে যান। সেখান থেকে দুপুর ১টার দিকে এসে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উখিয়ার জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্বধার বৈঠকে বসেন। অভিযানে আসা বিভিন্ন সংস্থার একাধিক লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উচ্ছেদ অভিযান যদি করাই না হয়, তবে কেন সরকারের এত অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন সংস্থার লোকজনদের জড়ো করে আনা হলো। তাদের মতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও অর্থায়ন যেমন রহস্যময়, তেমনি উচ্ছেদ অভিযানে আসা লোকজন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়া আরও রহস্যজনক। এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিলোল বিশ্বাস, উখিয়ার বন রেঞ্জ কর্মকর্তা ইব্রাহীম হোসেন, উখিয়া থানার ওসি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কোন কিছু জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শেখ ফরিদ উদ্দিন ও কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল সরকারের নেতৃত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিলোল বিশ্বাস, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচ মাহফুজুর রহমান, উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন মজুমদার, কক্সবাজার সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ছত্রধর ত্রিপুরা, সহকারী বনসংরক্ষক রেজাউল করিম চৌধুরী, সহকারী বনসংরক্ষক আব্দুল হাইসহ বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিসসহ একাধিক সংস্থার প্রায় আড়াই শতাধিক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী উচ্ছেদ অভিযান চালাতে উখিয়া গিয়েছিলেন।
×